নীতির রাজাকে রাজনীতি বলে, নাকি রাজার নীতিকে রাজনীতি বলে- তা এখনও স্পষ্ট বুঝিনা। ব্যাকরণগত ব্যাখ্যাও নেই আমার কাছে। তবে প্রজা বা জনতা বা গণমানুষের জন্যই যে রাজনীতি-এটা কিছুটা হলেও বুঝি। কালে-কালে যুগে-যুগে আমরা অনেক রাজনীতিবিদকে দেখেছি, তাঁরা গণমানুষের কল্যানে কত না অবদান রেখে গেছেন। অবশ্য এই অবদান রাখতে গিয়ে আলোচিত বা সমালোচিত হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে, দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক ত্যাগী নেতাকে।
আমরা বিশ্ববাসী হিটলারের কঠোর সমালোচনা করতে বেশ পছন্দ করি। তবে হিটলারের জন্ম না হলে আধুনিক জার্মানের জন্ম হতো কিনা- তাতে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। সমাজতান্ত্রিক নেতা হিটলার গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় এসে প্রথমেই যে কাজটি করেন, তা হলো নাতশী নিধন। তিনি সে সময় যথার্থই বলেছিলেন ‘ইহুদীরা কোন সভ্যতা গড়েনি, বরং তারা জানে সভ্যতাকে ধংস করতে’। আজ প্যালেস্টাইনের দিকে তাকালে হিটলারের ওই বক্তব্যের সত্যতা মিলে।
অপরদিকে অভাবে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেড়ে আফিম খেয়ে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থাকতো যে চৈনিকেরা, মাও সেতুংয়ের মত লৌহমানব চীনের ক্ষমতায় এসে অন্ধ কুপ হত্যাযজ্ঞ যদি না চালাতো, তবে আধুনিক চীনের জন্ম হতো কিনা, তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ যখন অভাবের তাড়নায় ক্ষুধা নিবাড়নের জন্য সাপ, শিয়াল-কুত্তার মাংস খেয়ে উদর পূর্তি করতো, ঠিক এমনই এক সময়ে প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং ক্ষমতায় এসে নিজে ঘুমাননি, কাউকে ঘুমাতেও দেননি। তিনি কাজ আর কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। আজ দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত।
আফ্রো-এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্রকামী মানুষের নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অনেকটা উল্লেখিত নেতাদের মতই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বড় উদার পন্থায়। আর তাঁর এই উদারতার মূল্য দিতে হয়েছিল গোটা পরিবারের প্রাণের বিনিময়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কালে তারই নাতিপুতিরা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকেও হার মানিয়ে ডিজিটাল বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছে। সোনার বাংলা গড়ার ফর্মুলার মধ্যে কি ডিজিটাল বাংলার বীজ নিহিত ছিল না? গ্রামবাংলায় একটা কথা আছে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হলে বাঁশও বাঁচেনা, কঞ্চিও বাঁচে না।’ জানিনে আমরা কোন পথে ধাবিত হচ্ছি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের গণতন্ত্র প্রীতি যথেষ্ট গর্ব করার মত। তবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর রামাবলী গায়ে জড়ানো দলগুলির মধ্যেই গণতান্ত্রিক পরিবেশের বড় অভাব। দলকানা বা দলদাশ ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দলের সদস্যপদ ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। প্রতিটি দলেরই কিছু লিখিত আদর্শ রয়েছে। দলের কর্মী বা পাতি নেতা বা হাফ নেতা হতে হলে দলের আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে ওই দলের নেতার একান্ত বাধ্যানুগত মোসাহেব ও সেবাদাশ হওয়াটা এখানে জরুরী। নীতির রাজাকে কোরবানী দিতে হবে, দলের নীতিকে বলি দিতে হবে, দলপ্রধানে মোসাহেবগিরি বাড়াতে হবে, তবেই দলে আপনার একটা হিল্লে হতে পারে।
বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসার মানুষের অভাব আজো নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষেরও কমতি নাই। তার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজো নিজগৃহে যেন পরবাসী। আর এ অবস্থার জন্য কি রাজাকার, আলবদর আলশামস্ তথা জামায়াতীরাই কি এককভাবে দায়ী? স্বাধীন বাংলায় রাজাকারের গাড়ীতে লালসবুজের পতাকা কে বা কারা তুলে দিয়েছিল ? স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিরা পশ্চিমা হায়েনা ও তাদের এদেশের দোসরদের হাতে মার খেয়ে সে মার কি কখনও হজম করতো? কিন্তু স্বাধীন বাংলায়? সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ রাজাকারদের হাতে মার খেয়ে সে মার হজম করতে বাধ্য হচ্ছেন কেন? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমনটি কি কখনও হতে পারে, নাকি হওয়ার কথা? ক্ষমতার লোভে গণতন্ত্রের রামাবলী গায়ে দিয়ে নব রুপে আবির্ভুত হয়েছে পশ্চিমা হায়েনার দলের চাইতেও হিংস্র নরপশুর দল। পাকিস্তানী হায়েনারা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনের বান্ডিল পোড়ায়নি, কর্মজীবী মহিলাদের খারাপ মহিলা বলে আখ্যায়িত করেনি। অথচ তাদের সেই অসমাপ্ত কাজগুলোকে সমাপ্তের প্রতিশ্র“তি নিয়ে স্বাধীন বাংলার রাজনীতির মাঠ কাঁপাচ্ছে কিছু রাজনৈতিক দল। আর আমরা তাদেরকে তৃষ্ণায় পানি দিচ্ছি, নৈতিক সমর্থন দিচ্ছি, তাদের হয়ে কথা বলছি।
অনেক মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দিনে দিনে বেড়ে মহিরুহে পরিণত হচ্ছে রাজাকার আলবদর আলশামস্ এর মত পরাজিত যুদ্ধাপরাধীরা। এ কথা চ্যালেঞ্জ করে বলা যায়, কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি ওই পরাজিত শক্তির কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়, তবে তারা কখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না বাংলার মাটিতে। রাজনীতির বিসর্জনকৃত নীতি বুকে আঁকড়ে ধরে একাত্তরের স্মৃতিকে একটু খতিয়ে দেখলেই সব বালাই চুকে যায়। বঙ্গবন্ধুর মত করে বাংলার মানুষকে ভালবাসতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উসকে উঠবে প্রতিটি বাঙ্গালীর প্রাণে। প্রেমে এবং যুদ্ধে সততার প্রয়োগ মানেই পরাজয়ের শিকল পড়া। সশস্ত্র সংগ্রামে চল্লিশ লাখ মানুষের প্রাণহানী বঙ্গবন্ধু কামনা করেননি। দু’লাখ মা বোনের ইজ্জত সম্ভ্রম নষ্টের কথা তিনি স্বপ্নেও দেখেননি। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এতটাই উজ্জীবিত ছিল যে, তাদের জীবন, তাদের ইজ্জত, তাদের সম্পদ সবই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল স্বাধীকারের প্রশ্নে। এটাই রাজনীতি। তেল-জল একত্রে মিশিয়ে একই তরল বলে শতভাবে প্রচার করলেও তা সত্যি হয় না।
আমাদের দেশের রাজনীতি আজ জলে-তেলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কে রাজাকার আর কে মুক্তিযোদ্ধা, চেনা বড় দুস্কর। আবার কে কোন দলের সমর্থক তাও শনাক্ত করা কঠিন। এটা শুধু তৃণমূল কর্মীর বেলায় প্রযোজ্য নয়, বরং কেন্দ্রীয় নেতাদের বেলায়ও প্রযোজ্য। নীতি বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি করলে যা হয়, আমাদের দশা অনেকটাই তাই হয়েছে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসতে না পারলে রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণের কথা বলে গণমানুষের কষ্টই বাড়াতে থাকবে। দলদাশ বা দলকানা না হয়ে আদর্শের পুজারী হওয়াটা জরুরী এবং আদর্শই পারে দেশের জন্য এবং দশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে। রাজনীতির রাজাদের অহমিকা ও জেদ কমিয়ে জনকল্যাণের কথা স্মরণ করতে হবে। সহনশীলতার মোড়কে নিজেদেরকে জড়িয়ে বেফাস কথাবার্তা ও মিথ্যাচার পরিহার করে জনগণের সমর্থন চাইতে হবে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস- একথা ভুলে গেলে জনগণই একদিন প্রত্যাখান করবে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।
