শিক্ষা হল মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপাদান। শিক্ষা ব্যক্তি জীবনের উৎকর্ষ সাধন করে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক জনশক্তি সরবরাহ করে থাকে। শিক্ষা ও জীবনের আদর্শ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটি দেশের শিক্ষার লক্ষ্য তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ফলে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেএে প্রাচীন গ্রীক যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হল ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও সামাজিক চাহিদা – এ দু’টির মধ্যে কোনটিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হবে ?
শিশু জন্মগতভাবে কতগুলো ক্ষমতা এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিক্ষার কাজ শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাকে স্বতন্ত্র এবং পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বে পরিণত করা। কিন্তু শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ শূন্যে সম্ভব নয়। কারণ শিশু সমাজে বাস করে, তাই শিক্ষার শুরুতেই আমাদের নির্ধারণ করে নিতে হবে শিক্ষায় ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোনটিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে ? শিক্ষাতত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে আপাতবিরোধী দুটি ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। এ দু’টি ধারা হল ব্যক্তিতন্ত্রবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ।
ব্যক্তিতন্ত্রবাদ তথা মনস্তত্ত্বের দিক থেকে শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির সাথে পরিবেশের সংগতিবিধান এবং এ ব্যাখ্যায় ব্যক্তিকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রবাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল সমাজ সংরক্ষণ ও সমাজের প্রগতি। এ দুই মতবাদের দ্বন্দ্ব শিক্ষাতত্ত্বের ইতিহাসে বারবার উপস্থিত হয়েছে এবং আধুনিককালে তীব্র আকার ধারণ করেছে। সমাজতন্ত্রবাদের মতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছাড়া ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে না। মানুষ সমাজে জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং আগে সমাজ, পরে ব্যক্তি।
সামাজিক মঙ্গল ও সংহতির মধ্যেই ব্যক্তির মঙ্গল ও অস্তিত্ব সম্ভব। তাই ব্যক্তি স্বার্থ সমাজের স্বার্থে রূপান্তরিত হবে। সমাজের স্বার্থে ব্যক্তি নিজেকে নিয়োজিত করবে। সমাজ ছাড়া ব্যক্তির জীবন অসম্ভব। ব্যক্তির আশা-আকাঙ্খা, সংগ্রামের সার্থকতা, নীতিবোধ, ধর্মবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবই সামাজিক জীবনের মাধ্যমে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে। একমাত্র সমাজই ব্যক্তির নিরাপত্তা, শান্তি, জীবিকার্জন প্রভৃতি চাহিদা মেটাতে পারে। সমাজের সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ। মানুষ জন্মে সমাজে,জীবনের বিকাশ খোঁজে সমাজে,মারা যায় সমাজে। তার সকল কর্ম, সকল কল্পনা, সকল ধ্যান ধারণা সমাজের পটভূমিকায় রচিত হয়। সে তার দেহ মন নিয়ে তার নিজস্ব গন্ডিতে বাস করে না। তার চিন্তার, কর্মের পরিধি নিজস্ব গন্ডির সীমা ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক মতবাদ জার্মান দার্শনিক হেগেল এর রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মতে সমাজ একটি আধ্যাত্মিক জীবন। প্রতিটি ব্যক্তিসত্বা সেই আধ্যাত্মিক সত্তারই সীমিত প্রকাশ। সমাজ বা আধ্যাত্মিক জীবন ছাড়া ব্যক্তির জীবন অবাস্তব এবং মূল্যহীন। সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে যাঁরা উগ্রবাদী তাঁরা সমাজকে একটা জীবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। হাবার্ট স্পেনসার সমাজকে একটি জীবদেহের সাথে তুলনা করে বলেন,প্রতিটি ব্যক্তি হচ্ছে জীবদেহের এক একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। দেহ ছাড়া একটি অঙ্গ বা কোষের যেমন মূল্য নেই, তেমনি সমাজ ছাড়া ব্যক্তির কোন মূল্য নেই। একটি জীবকোষ দেহের মধ্যেই যেভাবে প্রাণ পায়, তেমনি ব্যক্তিও সমাজের মধ্যেই বেঁচে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্য হল সমাজ সংরক্ষণ এবং সমাজ প্রগতি। সামাজিক চাহিদা প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত হবে। শিক্ষারও লক্ষ্য হবে সমাজকল্যাণের পথে নিজেকে নিয়োজিত করা। শিক্ষা এমন হবে যে,তার দ্বারা সমাজ জীবন পুষ্ট হবে। সমাজজীবন পুষ্ট হলে ব্যক্তি জীবনেরও পরিস্ফুটন হবে। তার কারণ ব্যক্তি সমাজেরই একজন।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবর্তিত বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের সামাজিক চাহিদার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গ্রীসে প্লেটো যে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন,সেখানে তিনি ব্যক্তির চাহিদার চেয়ে সমাজের চাহিদাকে বড় করে দেখেছেন। গ্রীক রাষ্ট্র স্পার্টা,আধুনিক যুগে হিটলারের জার্মানিতে ও মুসোলিনীর ইতালিতে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ধারার প্রবর্তন হয়েছিল। কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র চীন- এ সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার প্রচলন এখনও রয়েছে। প্রাক্তন রাশিয়াতেও এধরনের শিক্ষা বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার অন্যান্য মতবাদের মত সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা হল: এই মতবাদে সমাজের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, ব্যক্তিকে রাখা হয়েছে পেছনে। মনোবিদ্যার বিশ্লেষণে প্রত্যেক ব্যক্তি একটি আলাদা সত্ত্বা। তার নিজস্ব আশা, আকাঙ্খা ও অনুরাগ রয়েছে।
ওইসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে শিক্ষা দিতে গেলে সমাজব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলাই বেশি দেখা যাবে। ফলে প্রকৃত অর্থে সমাজকল্যাণ সম্ভব হবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিকে সামাজিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে গতানুগতিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়ে একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ব্যক্তির নিজস্ব সৃজনী প্রতিভার বিকাশ ব্যাহত হবে। এতে সামাজিক অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। অনেক সময় চরম সমাজতান্ত্রিক উদ্দেশ্য উগ্র জাতীয়তাবাদ,প্রতিবেশী দেশের প্রতি আগ্রাসন এবং সংঘাত সৃষ্টি করে। জার্মানী ও ইতালিতে এ ধরনের শিক্ষার উদ্ভব হয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তি ও সা¤্রাজ্যশক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যক্তির চাহিদাকে উপেক্ষা করে সেখানে সমাজের চাহিদাকে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। আধুনিককালে ব্যক্তিতন্ত্রবাদের উৎপত্তির ফলে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক দক্ষতার প্রতি বিরূপ মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে সামাজিক দক্ষতার পরিবর্তেৃ ব্যক্তিগত উন্নয়ন তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। সমাজতন্ত্রবাদের সীমাবদ্ধতা থেকে দেখা যায় যে,সমাজতন্ত্রবাদ একদর্শিতা দোষে দুষ্ট। এতে সমাজকে অত্যন্ত বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
আসল কথা, সমাজ ছাড়া যেমন ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্ভব নয়, তেমনি ব্যক্তি ছাড়া সমাজও সম্ভব নয়। ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে । ব্যক্তি যে কারণে সমাজ সৃষ্টি করে, সমাজও সেই অর্থে ব্যক্তিকে সৃষ্টি করে। আসলে একটি সৃজনশীল সমন্বয়ের মধ্যে ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষা উভয় মতবাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে। অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। যে কোন সুসংগঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীর আশা, আকাঙ্খা, অনুরাগ ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিবে, অন্যদিকে তা সমাজকাঠামো, সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি ও চাহিদার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, বিলাইছড়ি, রাঙ্গামাটি।
E-mail: jashim.cht@gmail.com