বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) সংবাদদাতা : ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তার দুর্ণীতিতে সরকারি প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা ও নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করে ব্যাকডেটে নিয়োগ প্রদানের কারণে জেলা জাতীয়করণ যাচাই-বাছাই কমিটির তদন্ত কমিটি ১৫ শিক্ষকের নিয়োগকে অবৈধ দেখিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দাখিল করেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিভিন্ন রেজিস্টার্ড বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূণ্যপদ বিদ্যমান থাকলেও তৎকালিন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম ব্যাকডেটে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এ সকল শূণ্যপদে নিয়োগ প্রদান করেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ১০ জুন দেশের সকল রেজি. বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারির পর ব্যাকডেটে দুর্ণীতিবাজ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিকে নানাভাবে বে-কায়দায় ফেলে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ১২ টি বিদ্যালয়ে ১৫ শিক্ষককে নিয়োগ প্রদান করেন। কোন কোন বিদ্যালয়ে স্বজন-প্রীতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পিতা তার মেয়েকে অবৈধভাবে শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করেন। নিয়োগের ভুঁয়া কাগজ-পত্র প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে অবৈধভাবে নিয়োগকৃত এ সকল শিক্ষকের বিল-ভাতাও চালু করা হয়। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি এ সকল নিয়োগকে অবৈধ নিয়োগ ঘোষণা করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালামের নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ উলেখ করে মতামত প্রদান করেন। তদন্ত কমিটি ১ অক্টোবর তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে দাখিল করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১০ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সকল রেজি. বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন জারির পরে দেশের বিভিন্ন রেজি. বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যমান শূণ্যপদে সরকারিভাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে সার্কুলারের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় যোগদান করেই ২০১০ সাল পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শূণ্যপদ থাকা সত্তে¡ও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পূর্ববর্তী কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল, পত্রিকায় ভুঁয়া বিজ্ঞপ্তি এবং নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজ-পত্র জালিয়াতি করে ব্যাকডেটে ১২ টি বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করে তাদের বিল-ভাতাও চালু করান। পরবর্তীতে এ সকল অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে গোটা জেলায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। প্রতিপক্ষের লোকজন নিয়োগের পরপরই প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের পর প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জয়নুল আবেদিন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা শিক্ষা অফিসে সরাসরি প্রাথমিক তদন্ত করে নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু কাগজ-পত্র জব্দ করেন। তাঁর তদন্তে অবৈধ নিয়োগের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ বিষয়ে একটি বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। ৯ জুন প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নবী হোসেন তালুকদার চুড়ান্ত তদন্ত করেন ।
এদিকে দেশের বিভিন্ন প্রকৃতির বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কর্মরত শিক্ষকদের জাতীয়করণ ঘোষণার পর প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত বিদ্যালয়সমুহের সম্পদ, অবকাঠামোগত অবস্থা, পাঠদান পরিস্থিতি, শিক্ষকের যোগ্যতা ও নিয়োগ পদ্ধতি বাস্তব যাচাইয়ের জন্য উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন করে। উপজেলা কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের প্রাক্কালে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার জনৈক মজিবর রহমান এ কমিটির আহŸায়ক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সদস্য সচিব উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করেন। রহস্যজনক কারণে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি অভিযোগের বিষয়টি আমলে না নিয়ে চুড়ান্ত রিপোর্ট জেলা কমিটির নিকট দাখিল করেন। পরবর্তীতে, অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গত ২২ এপ্রিলের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে দায়িত্বে থেকে তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মো. আব্দুল ওয়াহেদ , পিটিআই’র সুপারিনটেন্ডেন্ট নির্মল চন্দ্র বর্মন ও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন। দীর্ঘ পাঁচ মাস তদন্ত শেষে গত ১ অক্টোবর এ সকল নিয়োগকে অবৈধ উলেখ করে তাঁরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রিপোর্ট দাখিল করেন।
তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ঠাকুরগাঁও পিটিআই’র সুপারিনটেন্ডেন্ট নির্মল চন্দ্র বর্মন জানান, তদন্ত রিপোর্টের সাথে অভিযোগকারী, অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ ৪৫ জনের জবানবন্দি রেকর্ড ও সংরক্ষণ এবং নিয়োগ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস্সহ ৬শ’৪০ পৃষ্ঠার প্রমাণাদি সংযুক্ত করা হয়। তদন্তকালে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারে অনিয়ম সংক্রান্ত একটি পত্রিকা জব্দ করা হয়। পত্রিকাটিতে প্রকৃত পত্রিকার সংবাদ কলামে সংবাদ অবলেপন করে ভুঁয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার দেখানো হয়। তদন্তে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ১২ টি বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষককে নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। যা তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলো- উত্তর বালিয়াডাঙ্গী তুলশিপাড়া রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাসনা বানু ও মিনা বেগম, কিশমত পলাশবাড়ীতে সুরাইয়া পারভীন, উদয়পুরে শ্রীমতি অনিকা রানী, গড়িয়ালীতে মোছা. সোহাগী পারভীন, কলন্দায় আব্দুস সবুর ও জান্নাতুল ফেরদৌস, দুওসুও গান্ডিকারীতে রুবিনা আকতার, দিশারীতে নাসিমা আকতার, হাড়িপুকুরে বিলকিস বানু, ছোট সিঙ্গিয়ায় কামরুন নাহার, তারাঞ্জুবাড়ীতে আকলিকা খাতুন, বড়কোটে রোজী আকতার এবং লোহাগাড়ায় বন্দনা রানী ও কোহিনুর বেগম। এ সকল বিদ্যালয়ে নিয়োগ বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারির পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত শূণ্যপদ থাকলেও ব্যাকডেটে ২০০৯ সালের ১০ জুনের পূর্বেই তাঁদেরকে নিয়োগ দেখোনো হয়।
এ ব্যাপারে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে কয়েকজন জানান, তৎকালিন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম বিভিন্ন প্রলোভনে চাকরি দেয়ার নামে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রদান করেন এমনকি আমাদের বিল-ভাতা পর্যন্ত চালু করেন। আমরা আগে তার চালাকি বুঝতে পারিনি। সহায়-সম্পদ বিক্রি করে তাকে বিশাল অর্থ দিলেও আমরা এখন চাকুরীর অনিশ্চয়তায় ভুগছি। বিভাগীয় মামলা ও তদন্তের জন্য তিনি বারবার আমাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিলেও তদন্ত রিপোর্ট আমাদের পক্ষে নিতে পারেন নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক ওই দুর্নীতিবাজ শিক্ষা অফিসারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি জানান।
অপরদিকে, দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায় বর্তমানে কর্মরত উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামের সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হন নি।

অপরদিকে, ইতোপূর্বে বিভাগীয় মামলাসহ এ সকল অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সহকারী জজ আদালতে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের হয়।
