
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৃনমূল থেকে উঠে যাওয়া শেরপুরের গণমানুষের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান আতিক দশম জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় হুইপ মনোনীত হয়েছেন। তার এ মনোনয়নের মধ্য দিয়ে ‘মাটি ও মানুষের একজন নেতা’কে যেমন মূল্যায়ন করা হয়েছে, ঠিক তেমনি স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪২ বছর পর শেরপুর সদর আসন থেকে এই প্রথম আওয়ামী লীগের তরফ থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় একজন হুইপ মনোনয়ন দেওয়ায় শেরপুরবাসীকেও মূল্যায়ন করা হয়েছে। যে কারণে ২৪ জানুয়ারী শুক্রবার তার হুইপ মনোনয়নের সংবাদ শেরপুরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দলীয় অঙ্গণসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তা শহর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে পরিণত হয়। এদিন জুমার বার হওয়ায় শহর-পাড়া-মহলার অধিকাংশ মসজিদেই তার হুইপ মনোনীত হওয়ায় শোকরিয়া আদায় করা হয়। বিকেলে শহরের থানামোড়, নবীনগর, বাসস্ট্যান্ড, আখেরের বাজার, খোয়ারপাড়, তাতালপুর বাজার, সাংসদের নিজ এলাকা তারাকান্দি ও ভীমগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি খাওয়ানোর ধুম পড়ে যায়। প্রাপ্তির আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন ছেলে-বুড়োসহ অনেকেই।

বলাবাহুল্য, শেরপুরের মানুষের ওই আনন্দ-উচ্ছাসের যৌক্তিক কারণটিও সহজ। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেরপুর-১ (সদর) আসনে প্রয়াত সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন আহমদের পর এ আসনটি দখলে ছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। ৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং তার দীর্ঘ ২১ বছর পর ৯৬ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের মেয়াদে একজন কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে প্রথম দফাতেই নির্বাচিত হন আতিউর রহমান আতিক। এরপর থেকে এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলেই এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তিনিই টানা ৪ বার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এরশাদপতœী, সাবেক ফার্ষ্টলেডি রওশন এরশাদ ও জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ হেভিওয়েট প্রার্থীদের পরাজিত করে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়েছেন। এরপরও পেছনের যে ইতিহাস তা হচ্ছে, তিনি দ্বিতীয়বারের উপজেলা নির্বাচনে শেরপুর সদর থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে তিনি শেরপুর সরকারী কলেজের ভিপি ছিলেন। আর ছাত্রজীবন বিশেষ করে স্কুলজীবনে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে আর দেশমাতৃকার টানে ঝাপিয়ে পড়েন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সেইসূত্রে তিনি শেরপুরের কনিষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধাও।
সে যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধ শেষে রণাঙ্গণ থেকে ফিরে এসেও থেমে থাকেনি তার নিরন্তর যুদ্ধ। শিক্ষাজীবন পেরিয়ে তিনি দেশ ও মানুষের সেবার মহান ব্রত নিয়ে নির্বাচনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। শেরপুর সদরের একই এলাকা থেকে টানা ৫ বার যার বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের মনোনয়নে ভিপি নির্বাচিত হওয়াসহ ছাত্র রাজনীতিতে একটি সময় পেরিয়ে তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েন মূল সংগঠনের রাজনীতিতে। আর এই সুবাদে তিনি তৎকালীন সভাপতি এডভোকেট এমএ ছামাদ, ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বাধীন জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে দুইবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একবার সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়ে সমান সংখ্যক ভোটপ্রাপ্তি এবং পরে সম্মেলনের প্রধান অতিথি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নির্দেশে তিনি ছাড় দিয়ে সরে দাড়ান প্রার্থীতা থেকে। এর পরবর্তী সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বর্তমানে বহাল থাকা কমিটির তিনিই সভাপতি। একাধারে সদরের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর তার ওপর দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কিন্তু এরপরও হিমশিম খেতে হয়নি তাকে। মেজাজহীন, নম্র স্বভাবের হয়েও অনেকটা সাহসিকতার সাথেই গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। ছাত্রজীবন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ যুগের রাজনৈতিক জীবন, প্রায় ১৮ বছরের জনপ্রতিনিধিত্বকালীন সময়ে তিনি নিয়মিত ভোর থেকে উঠে মধ্যরাত অবধি মানুষের সাথে মিশে সর্বোপরি শেরপুরের উন্নয়ন আর অগ্রগতিতে যতটা সময় দিয়েছেন, স্বীকার করেছেন যতটা ত্যাগ-তিতীক্ষা, ততটার মূল্যায়নের স্বার্থে এবার অন্তত: একজন প্রতিমন্ত্রী বা হুইপ মনোনীত করা হবে তাকে- শেরপুরবাসীর এমন প্রত্যাশিত দাবিটা ছিল সময়ের যৌক্তিক দাবি। আর এক্ষেত্রে মন্ত্রীর কোঠায় সম্ভব না হলেও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় হুইপ মনোনীত করে তার যথার্থ মূল্যায়নে সংসদ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যিই সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন।
আজকে তার মূল্যায়নে শেরপুরবাসীর পাশাপাশি সর্বাগ্রে যিনি খুশি হতেন, সেই গর্ভধারিণী মা মালেছা খাতুন (৯০) মাত্র কিছুদিন আগে (৩০ নভেম্বর) না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কর্মব্যস্ততার ফাকে ঢাকা থেকে শেরপুরে এবং শেরপুর থেকে নিজ জন্মভূমি বারঘরিয়ার বাসায় ফেরার পর প্রথমেই যার খোজটি নিতেন তিনিই সেই রত্নগর্ভা মা মালেছা খাতুন। অন্যান্যবারের মত এবারও তিনি স্বাভাবিক নিয়মেই ফিরবেন। কিন্তু ব্যতিক্রম হবে কোন সিএনজি বা ভাড়ায় গাড়িতে নয়, পতাকাবাহী গাড়ীতে করে। ঠিক তখন মাকে কাছে না পেয়ে তার মনটি নিশ্চয় ডুঁকড়ে কেদে উঠবে। দু:খিনী মা দেখতে পাবেন না পতাকাবাহী গাড়ীতে করে কবরের পাশে দাঁড়ানো আদরের খোকাকে। এরপরও তার সান্তনা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মা-বাবাকে হারালেও হাজারও মা-বাবাকে আপন করে নিয়েছেন নিজের মত। আদর, আশির্বাদ, দোয়া সবকিছুই ঘিরে আছে তাকে, আর তার চলার পথকে।
একজন হুইপ হিসেবে নিজ বলয়ের সাংসদদের সংসদে কলাকৌশল ও নীতিনির্ধারণ বিষয়ক পূর্ব অবগতি ও ধারণা দেওয়াই মূল কাজ হলেও তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠ হওয়ায় সংসদের বাইরেও তার মর্যাদা ও কর্তৃত্বকে নি:সন্দেহে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। একজন অভিজ্ঞ সাংসদ ও জননন্দিত নেতা হিসেবে তিনি তার কাজের পরিধি বি¯তৃত হওয়ায় ঠিক ততটাই সচেতন ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে নিজেকে নিবেদিত রাখবেন, মাটি ও মানুষের সাথে গড়ে উঠা নিবিড় সম্পর্কে কোন ছেদ না ঘটিয়ে কিংবা দূরত্ব না বাড়িয়ে মিশে থাকবেন নিজের অস্তিত্বের শেকড়ের সাথে। নিজেকে মুক্ত রাখবেন চেলা-চামন্ডা, তোষামোদি, সুবিধাভোগি গোত্র থেকে। এগিয়ে যাবেন আরও সামনের দিকে- আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে শেরপুরবাসীর তরফ থেকে এই প্রত্যাশা আমাদের। জয়তু; সাংসদ আতিক, জয়তু; শেরপুরবাসী।
লেখক : সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিক, শেরপুর, ই-মেইল : press.adhar@gmail.com
