অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের অতিকথন, ফালতু বচন, মধ্যরাতের রাতজাগা পন্ডিতদের পান্ডিত্যের বিশেষণ-অতি বিশ্লেষণে ভূ-কম্পন নয়, জনমনে হৃদকম্পনের সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছে। দেশজুড়ে শিক্ষিত-অতিশিক্ষিত, মূর্খ-অতিমূর্খ সবার এখন একই ভাবনা কোথায় যাচ্ছে দেশ, কোথায় আমরা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দিনকে দিন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে। প্রধান দুই দলের দুই প্রধানের ব্যক্তি আক্রোশ, অসহনশীল মনোভাব আর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার অতিমোহেই দেশে আজ অস্থিতিশীল অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আজকের এই মুহূর্তেরও ‘যত সমস্যা তত সমাধান’ বাক্যটি মিথ্যা হতে পারেনা। অতীতে যত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা বাঙ্গালি জাতি সুনিপূণভাবে সমাধান করতে পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছেন। মহান স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু অকল্পনীয় হিমালয়সম সমস্যার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ জাতি নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, দৃঢ় মনোবল, অসীম সাহসিকতা ও সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে বারবার। জন্ম দিয়েছে ৫২ থেকে ৭১ এর সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মত ইতিহাসের। যা আমৃত্যু গর্বের লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কোন মানুষ নেই। সবাই যেন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। এদেশ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির একার নয়। এদেশ ১৬ কোটি বা তারও বেশি মানুষের। আমরা বাঙ্গালি, বাংলাদেশি। ‘বাংলা মোদের মায়ের ভাষা, গর্বের ধন’। একই ভূখন্ডের অধিবাসী আমরা সবাই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় অনাদিকাল থেকে আমরা মিলেমিশে বসবাস করে আসছি। আজকাল ক্ষমতার অতিলোভই অহিংস রাজনীতিকে সহিংস করে তুলেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রবল স্বৈরাচারী, এক নায়ক, রাষ্ট্রশক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে নিপীড়িত নির্যাতিত নিরস্ত্র মানুষের দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে উপমহাদেশে হরতালের প্রথম সূচনা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু হরতাল ছিল অহিংস। সেই অহিংস হরতালেও পুলিশী হামলা ছিল। তবে হরতালকারীরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ওপর কখনও হামলা করেনি। লবন সত্যাগ্রহের সময় চৌড়িচূড়ায় জনতা সহিংস হয়ে পুৃলিশের ওপর হামলা করলে মহাত্মা গান্ধী সেই আন্দোলন স্থগিত করেছিলেন। সেই অহিংস আন্দোলনের মোহে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। অহিংস হরতাল যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি অহিংস হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-বোমাবাজী, হতাহতের ঘটনা গণতন্ত্রকে সু-প্রতিষ্ঠিত করে না, বরং প্রশ্নবিদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করে। সহিংস হরতাল যদি গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, তবে মানা না মানাও যেকোন ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারই বটে। এখন হরতালের আগের দিনই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করে জনজীবনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে পরদিন ভোর না হতেই নেমে আসে দানবরূপী হরতাল। নির্বিচারে ভাঙচুর-আগুন, কুপিয়ে-গুলি করে মানুষ হত্যা, হাত-পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেয়া, গণমাধ্যমকে কোণঠাসা করার জন্য অফিসে ককটেল নিক্ষেপ, সাংবাদিকদের ওপর হামলা- এ কেমন হরতাল ? কেমন মানবিকতা ? এ কেমন গণতানিত্রক অধিকার ?
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে পূর্বে তাদেরই সৃষ্টি তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি উচ্চ আদালতে রায়ের মাধ্যমে বাতিল করে। এরই প্রতিবাদে জাতীয়বাদী দল বিএনপি তত্বাবধায়ক বহালের দাবিতে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের নামে বার বার আলটিমেটাম দিয়ে আসছিল। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক মহাসমাবেশে ২৭-২৯ তারিখ পর্যন্ত টানা ৬০ ঘন্টা হরতালের আহবান করে। ওই হরতালের দানবীয় রূপে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক মিলে ১৮ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকশত। আহতদের অনেককেই পঙ্গুত্বকে সাঙ্গ করে নিতে হবে আজীবন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শতশত যানবাহন, দোকানপাট। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। হরতালের পক্ষে বিপক্ষে মিছিল-মিটিং, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা শুধুই সংখ্যায় বিবেচ্য হতে পারে না। যেখানে জীবনের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে একজন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুই অনেক বড়। এর দায় দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতাদেরকেই নিতে হবে। ক্ষমতা লাভের অতিমোহে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বা সর্বদলীয় সরকার পদ্ধতি বাস্তবায়নে অনড় অবস্থান গ্রহণ, অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের তত্বাবধায়ক সরকার বহালের বাহাস। ওই রাজনৈতিক অস্থিরতা আজ সমগ্র জাতিকে বিষিয়ে তুলেছে। করেছে বিভ্রান্ত। জাতীয় অর্থনীতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার ওই কঠিন মুহূর্তে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের পাল্টাপাল্টি বিপরীতমুখী রূপরেখা প্রকাশ জাতিকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশাবাদী মানুষ হিসেবে তবুও কিছু আশার আলো রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশের ঈশানকোনে দেখতে পাচ্ছি। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সৃষ্ট সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগকে দেয়া চিঠি, তাৎক্ষণিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের ফোনালাপ বিদমান রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ৩৭ মিনিটের কথোপকথন যদিও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বা হরতালের মত কর্মসূচিকে বন্ধ করতে ও জাতিকে আশ্বস্ত করতে পারেনি, তবুও সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপের শুভ সূচনা হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সুধী মহলের অনেকেই। ১৮ অক্টোবর শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বা সর্বদলীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা এবং সর্বদলীয় সরকার গঠনে বিরোধী দলের সদস্যদের নামের তালিকা চেয়ে খালেদা জিয়ার প্রতি আহবান করার ৭২ ঘন্টা পর বিএনপি প্রধানের সাংবাদিক সম্মেলন করে তত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা পেশ করেন। যা পূর্বের তত্বাবধায়ক সরকারেই নামান্তর বা ভিন্নরূপ। পক্ষান্তরে হাসিনার প্রস্তাব সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য থেকে। দুই দলের দুই প্রধানের প্রস্তাব ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় ওই ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠায় আবারও সংবিধান সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রয়োজন হবে। সরকার তথা বিরোধী দলের প্রস্তাবে বিস্তর ফারাক থাকলেও উভয় দলের নির্বাচনকালীন রূপরেখা জনসম্মুখে পেশ দেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে মধ্যস্থতার অনেকটাই আশা জাগিয়েছিল। এরই মাঝে বেগম জিয়ার যুগপৎ আন্দোলন ওই আলোচনারই অংশ। তবে তত্বাবধায়ক সরকার পুন:প্রতিষ্ঠায় টানা ৬০ ঘন্টা হরতালের প্রাথমিক কর্মসূচি ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপের সংলাপ ও বিরোধী দলের হরতাল প্রত্যাহার না করা বিষয়টি দেশব্যাপী বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। চলমান সংকট উত্তরণে ওই ফোনালাপ শতভাগ সফলতা না পেলেও বিরোধী দলীয় প্রধানকে তার সঙ্গীয় লোকসহ নৈশভোজের আমন্ত্রণ সমগ্র জাতি বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ২৫শে অক্টোবর ১৮ দলীয় সমাবেশকে ঘিরে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের অনড় অবস্থানে সহিংসতার আশঙ্কায় জনমন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সেইদিনের পরিস্থিতি প্রশমনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সু-বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফসল বলা যায়। তবে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় ৮ জনের প্রাণহানি দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছিল। রাজপথে এ ধরনের হরতাল, অনাকাঙ্খিত মৃত্যু নতুন কিছু নয়। এ অবস্থায় সরকারের গণগ্রেফতার, দমন-পীড়ন, আটক বন্ধ করা শুভ বিবেকের পরিচয় হবে। তেমনি প্রধান বিরোধী দলেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সহিংস নয়, অহিংস আন্দোলন করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, দেশের এই অশান্ত পরিস্থিতিতে সাদেক হোসেন খোকার ‘দা-কুড়ালের রাজপথ’ অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ‘হরতাল পান্তাভাত’ এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য অবশ্যই দু:খজনক। এমন কঠিন দু:সময়ে পরিস্থিতি যাতে রাজনীতিবিদদের হাতের নাগালের বাইরে চলে না যায় তার আগেই উপায়ন্তর খুজে বের করা প্রয়োজন। বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবার পর দেশে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা যুগযুগ ধরেই প্রচলিত। জনগণ তাদের ভোটাধিকার যথাস্থানে প্রদান করবে এটাই নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশ চলছে তার উল্টোদিকে। প্রতিটি সরকারের শেষ মুহূর্তে যা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সংঘাতময়, এর থেকে পরিত্রাণের পথ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে চিরস্থায়ী একটি রূপরেখা তৈরি করা জরুরী। উদ্বেগ-উৎকন্ঠার ২৫ অক্টোবর হরতালের ২৭-২৯ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়ায় জাতিকে চরম অনিয়শ্চতা ও অন্ধকারের মধ্যে ফেলেছে। তবে জাতি আশা করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির কথা ভেবে আমাদের চলার পথে মহানুভবতাকে সাঙ্গ করা দরকার। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের হীন স্বার্থ যেন ১৬ কোটি বা তারও বেশি মানুষের লাল সবুজের এই দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি, শিক্ষা, জাতীয় অর্থনীতি ব্যাহত হোক তা কোন সভ্য মানুষের কাম্য নয়। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, গোটাজাতির স্বার্থে আমাদের ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে, সমঝোতায় আসতে হবে। অবাধ-সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেহেতু দুই দলই একমত সেহেতু অর্ন্তবর্তীকালীন, সর্বদলীয় বা তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোন কঠিন কাজ নয়। এর জন্য দ্ইু দলের দুই নেত্রীর সহনশীল উদার ও নমনীয় মনোভাবই যথেষ্ট। সম্প্রতি আমার অগ্রজ কলম সৈনিক রফিকুল ইসলাম আধার এর সমকালীন নিবন্ধ ‘চুলতত্বের বাহাস; আর নয় চুলোচুলি, কুলাকুলিতেই হোক সমাধান’ লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরাও চাই ব্যক্তি আক্রোশ নয়, রাজপথে সংঘাত-নৈরাজ্য নয়, যথেষ্ট হয়েছে হত্যা-গুম, জ্বালাও-পোড়াও, বিস্ফোরণ। সবই ভুলে জাতির জাতীয় স্বার্থে কুলাকুলিতেই সমাধান হোক সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের। অনুষ্ঠিত হোক সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, শান্তিতে ঘুমাক দেশের মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বার্তা সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম।