ইয়ানুর রহমান, যশোর : দেশের আর্ন্তজাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল কাস্টমস ইমিগ্রেশন দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের অন্তরালে চোরাচালানী ব্যবসা জমজমাট ভাবে চলছে বলে জানাগেছে। যার ফলে আশানুরুপ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মচারি কর্মকর্তা, পুলিশ ও স্থানীয় বিজিবি সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্যাম্পল আনার নামে নাম মাত্র শুল্ক পরিশোধ করে লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী পারাপার করছে চোরাচালানীরা। এতে, সরকার প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হলেও পকেট ভারী করছেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োজিত অসাধু কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস ইমিগ্রেশন ব্যবহারকারীরা জানান, বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে অবস্থিত কাস্টমস বিভাগের কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিভিন্ন পন্যের স্যমপুল (নমুনা) হিসাবে ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি হওয়ার নিয়ম আছে।
তবে, স্যামপুলের পরিমাণ ৫ কেজির অধিক হবেনা। এ আইনের আলোকে দীর্ঘদিন ধরে আমদানি-রপ্তানি কারকরা শাড়ি থ্রীপিছ মটর পাটর্সসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী স্যামপুল হিসাবে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমসে নিয়ে আসে। পরে, এখান থেকে সকল কার্যাদি সম্পন্ন করে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। কিন্তু এ আইনকে অপ-ব্যবহার করে এখানকার কিছু চোরাচালানী সদস্যরা অসাধু চেকপোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তা, ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তা, আইসিপি বিজিবি ক্যাম্প কর্মকর্তাসহ বেনাপোল থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাট ম্যানেজ করে কুরিয়ার সার্ভিসের আড়ালে অবাধে এ চোরাচালানী ব্যবসা পরিচালনা করছে।
এই চেকপোস্ট দিয়ে চোরাচালানী সিন্ডিকেটের সদস্যরা যেসব কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ব্যবহার করছে সেগুলো হলো এসিআই, ওসিআই, এশিয়া, কন্টিনেন্টাল, টিকেএস, মডার্ণ, প্রাইম, ইয়ারপ্যাক, ইমপেক্সসহ ১০ থেকে ১১ টি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চোরাচালানী পন্য বাংলাদেশ থেকে ভারত ও ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে আনা-নেওয়া করছে। ভারত থেকে শাড়ি, থ্রীপিছ, কসমেটিক্স, মটর পার্টস, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকদ্রব্য ও আগ্নেয় অস্ত্র দেশে আনছে। ভারতে পাঁচার করছে স্বর্ণের বার, তামা পিতলসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতবদ্রব্য।
ইমিগ্রেশন চেকপোষ্টের দায়িত্বশীল সুত্রগুলো জানিয়েছেন, জনৈক রহিম নামে এক দালাল সকাল থেকে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট কাস্টমস অফিসে অবস্থান নিয়ে এই কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্যাম্পলের নামে চোরাচালানী ব্যবসার দালাল হিসাবে রাম রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। এমনকি সে সারা দিনব্যাপী কাস্টমসের ভিতরে ঢুকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে মোটা অংকের চুক্তিতে ল্যাগেজ পার্টির অবৈধ মালামাল পারাপার করে থাকে।
সুত্র আরো জানিয়েছেন, বেনাপোল পোর্ট থানার অন্তর্গত গাতিপাড়া গ্রামের আব্দুর রহিম দির্ঘদিন যাবত বেনাপোলের চেকপোস্ট দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস ও ল্যাগেজ পার্টির অবৈধ মালামাল পাচারের শীর্ষ দালাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এ অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার কারণে রহিমের কাছ থেকে প্রতিদিনই বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তা, ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তা ও আইসিপি বিজিবি ক্যাম্প কর্মকর্তারা মোটা অংকের টাকা উৎকোচ হিসাবে পেয়ে থাকে। এ কারনে সে কুরিয়ার সার্ভিসের ঢোপ / বস্তার মধ্যে ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিছ, কসমেটিক্স সামগ্রী, মটর পার্টসসহ ফেনসিডিল ও হেরোইন এবং বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণের বার, তামা পিতলসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতবদ্রব্য পারাপার করে থাকে। এতে, বেনাপোল চেকপোস্টে দায়িত্ব প্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা ঐ ঢোপ / বস্তাগুলো নামে মাত্র হালকা মুখ খুলে দেখেন আবার কখনো না দেখেই ইশারা করে চলে যেতে বলেন।
এ বিষয়ে বিভিন্ন আমদানী-রপ্তানীকারকরা জানিয়েছেন কে এই রহিম? সে দালাল, নাকি রাজস্ব কর্মকর্তা?
এলাকাবাসী জানায়, বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের সময়ে নিজে বিএনপি নেতা ও ভাই রাইটার আলীর পরিচয়ে বেনাপোল চেকপোস্টে আগমন ঘটে আব্দুর রহিমের । ততকালীন সময়ে আব্দুর রহিমের ভাই মোহাম্মদ রাইটার আলী বর্তমান বেনাপোল পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নাছির উদ্দিনের পিতা ও বেনাপোল ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব বজলুর রহমানের ভাই গ্যানেট শামছুরকে হত্যা মামলার আসামী হওয়ায় চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন কাস্টমসে জায়গা করে নিতে বেগ পেতে হয়নি আব্দুর রহিমকে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে সে ভোল পাল্টে সকল মহলকে ম্যানেজ করে নেয়। চেকপোস্ট কাস্টমস, ইমিগ্রেশন পুলিশ, আইসিপি বিজিবি ক্যাম্প কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের চোখে সে হয়ে যায় চোখের মনি। এছাড়া বেনাপোল থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিভিন্ন থানা ও দপ্তরে সাপ্তাহিক/মাসিক মাশোহারা পৌছে দেওয়ায় তার মালামাল ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে যায়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ১৪/১৫ টি সুন্দরী যুবতী মহিলা ও পর স্ত্রীকে বিবাহ করেছে সে। বিয়ে করার ২/১ বছর পর ভালো না লাগলে মোটা অংকের টাকা দিয়ে অথবা হত্যার হুমকি দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে আব্দুর রহিমের ৪টি স্ত্রী রয়েছে। এ ৪ স্ত্রীর ৪ স্থানে আলিশন বাড়ি করে দিয়েছে। অবশেষে বাড়ির কাজের মেয়েকে বিয়ে করে ছোট স্ত্রী হিসাবে বেনাপোলের পাটবাড়ি আশ্রমের সামনে তৃতীয় তলা বিশিস্ট আলিশান বাড়ি নির্মান করে সেখানে বসবাস করছে প্রায়।
সুত্র আরো জানায়, বহুলালোচিত আব্দুর রহিমের ন্যায় কতিপয় কিছু দালাল চক্র কাক ডাকা ভোর থেকে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিসের আশ পাশে অবস্থান নিয়ে নানা অবৈধ কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। যাতে সরকার হারাচ্ছে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা রাজস্ব। ইতিপূর্বে বেনাপোল ও নাভারনসহ বিভিন্ন স্থানে এ চোরাচালানীপণ্য আটক হলেও অবাধে চলছে এ রমরমা ব্যবসা।
অপর একটি সুত্র জানিয়েছেন, বর্তমানে আব্দুর রহিম আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, বহু বিয়ের নায়ক আব্দুর রহিম যখন যে দল ক্ষমতায় যায় তখন সেই দলের ছত্র ছায়ায় থেকে রাতারাতি ভোল্ট পাল্টে চেকপোস্ট কাস্টমসে প্রভাব খাটিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তার ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন ল্যাগেজ পার্টি চেকপোস্ট কাস্টমসে ঢোকার সাথে সাথে সুচত’র আব্দুর রহিম কব্জা করে ফেলে। ঐ যাত্রীর ল্যাগেজে ১ লাখ টাকার মালামাল থাকলে রহিম নিজ ইচ্ছামত ২০ হাজার টাকা মূল্য দেখিয়ে রাজস্ব দেওয়ায়। অতিরিক্ত ৮০ হাজার টাকার মালের রাজস্ব রহিম ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। অনেক সময় কাস্টমসের রাজস্ব অফিসার এ অনিয়ম ও দূর্নীতিতে রাজি না হলে আব্দুর রহিম কাস্টম ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের মারধোর করার হুমকি দিয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে আব্দুর রহিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি দীর্ঘদিন যাবত বেনাপোল চেকপোস্টে ইমিগ্রেশন কাস্টমসের সাথে জড়িত আছি। এখান থেকে সূনামের সহিত কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্যাম্পল আনা-নেওয়ার দ্বায়িত্ব পালন করছি। ল্যাগেজের বিষয়ে কিছু জানিনা। আমার মাধ্যমে দুই নাম্বারি কোন কাজ হয়না। বিশ্বাষ না হলে এখানে এসে দেখতে পারেন।
এ বিষয়ে বেনাপোল ইমিগ্রেশন কাস্টমস সুপার ইমদাদ হোসেন জানান, এই ইমিগ্রেশন কাস্টমস দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কোন চোরাচালানী মালামাল পারাপার হয়না। বা ল্যাগেজ পার্টির কোন সিন্ডিকেট আছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমরা এখানে জয়েন্ট হওয়ার আগে এ ধরণের কিছু ছিল কিনা বলতে পারিনা। তবে, আমরা এখানে আসার পরে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। মাঝে মধ্যে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে হয়তোবা ৫ কেজির উর্দ্ধে ২/৫ শ’ গ্রাম মালামাল বেশি হতে পারে তা হয়তো ছেড়ে দিতে পারি।