মো.মহসিন মাতুব্বর আমতলী(বরগুনা) প্রতিনিধি: বরগুনার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের গুদিঘাটা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের গৃহবধু হ্যাপী বেগম (৩৪)। দিন মজুর স্বামীর অভাবী সংসারে ছোট ছোট দুই শিশু সন্তান নিয়ে অপুষ্টিজনিত রোগে-শোকে একসময় মূমুর্ষূ হয়ে পড়েছিলেন।
কখনও গ্রামীন সড়ক মেরামতের কাজ, কখনও বা এ বাড়ি ও বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে খেয়ে না খেয়েই চলত তাদের দৈনন্দিন জীবন।
ঝড়-বৃষ্টি আর অসুস্থতার কারনে যেদিন কাজে যাওয়া হত না সেদিন না খেয়েই উপোস থাকতে হত সবার।
আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রমের সমন্বয়ে সেই হ্যাপী বেগম এখন জয় করেছেন দারিদ্রকে। এখন আর ঝিয়ের কাজ করেন না তিনি। স্থানীয় এনজিও জাগো নারী থেকে এককালীন অফেরৎযোগ্য দশ হাজার টাকার আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে হ্যাপী এখন নিজেই তৈরী করেছেন নিজের কর্মসংস্থান।
দিনভর নিজের গরু, ছাগল আর হাঁস-মুরগী পালনেই দিন চলে যায় তার। দিনমজুর স্বামী কুদ্দুসকে একটি পুরোন রিক্সা কিনে দিয়েছেন হ্যাপী। রিক্সা চালিয়ে যা আয় হয় তার পুরোটাই ব্যায় হয় সংসার পরিচালনায়।
নিজের জন্য কিনেছেন কিছু হাঁস-মুরগী আর দু’টি ছাগল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে সংসারের সব খরচ মিটিয়ে একটি গরু কিনেছেন হ্যাপী বেগম। হ্যাপী বেগমের মতো ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন আমতলী উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের জামাল উদ্দিন, আরপাঙ্গাশিয়া গ্রামের পাপড়ি বেগম কিংবা শাহিদা বেগম। শুধু হ্যাপী, পাপড়ি, জামাল বা শাহীদা বেগম নয়,ক্ষুদ্র ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে হ্যাপী বেগমের মত দারিদ্রের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে বরগুনা সদর, বেতাগী ও আমতলী উপজেলার সাত ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার হত দরিদ্র পরিবার।

বাংলাদেশ সরকারের ইইপি প্রকল্পের আওতায় অক্সফামের সহযোগিতায় সিডর পরবর্তী সময় থেকে বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারী এবং আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশাখালী ইউনিয়নে উন্নয়ন সংস্থা এনএসএস রি-কল প্রকল্প নামে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন বিষয়ক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। স্থানীয় অধিবাসীদের সংগঠিত করে তাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমনের পাশাপাশি সকল প্রকার অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে ওই প্রকল্পটি শুরু হয় ২০০৯ সালে। এ প্রকল্পের অধীনেই বরগুনা, বেতাগী ও আমতলী উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে মোট একশ’র মতো স্থানীয় সংগঠন বা সিবিও গঠন করা হয়েছে।
এসব সিবিওর অধীনে যেসব হতদরিদ্র সদস্য রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন ট্রেন্ডের ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগী ও গবাদী পশু পালনের জন্য অফেরৎযোগ্য এককালীন দশ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের সর্বমোট তিন হাজার হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে এসব সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয় এ প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা এবং কর্মীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ সরাসরি কারিগরী সহযোগিতাও দেয়া হচ্ছে।

রি-কল প্রকল্পের জাগোনারী’র মাঠ কর্মকর্তা মোঃ শাহআলম জানান, এ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি হত দরিদ্র পরিবার তাদের আয়-রোজগারের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনায় এককালীন দশ হাজার টাকা পেয়েছে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের অধীনে কাজের বিনিময়ে অর্থ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আরও দুই হাজার আটশত পঞ্চাশ টাকার সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।
এনএসএস’র মাঠ কর্মকর্তা মনিরা সুলতানা সখী জানান, আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি হাঁসমুরগী ও গবাদি পশু পালনসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ওইসব পরিবারের ব্যবসায়িক আয় ব্যায়ের হিসেব সংরক্ষণসহ তাদের সকল কার্য্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যাতে দারিদ্রকে অতিক্রম করতে কেউ ব্যর্থ না হয়। তাছাড়া সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, পুকুর সংস্কার, বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট, কৃষি সহায়তা, স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা তৈরী, বনায়ন প্রভৃতি সহায়তা চলমান রয়েছে।
বরগুনার ফুলঝুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন তপন জানান, ‘সকল হতদরিদ্র সুবিধাভোগীর কর্মক্ষমতা যেহেতু এক রকম নয় সেহেতু শুধুমাত্র মাইক্রো ক্রেডিট ফরমূলায় দারিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়। তাই দারিদ্র বিমোচনে নানামূখী প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন।’
বরগুনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আলী জানান, দারিদ্র বিমোচনে বর্তমান সরকার নানামূখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। তার মধ্যে পলী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইইপি একটি অন্যতম প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় অক্সফামের সহযোগিতায় প্রকল্পটি দারিদ্র বিমোচনে কার্যকরী ভ‚মিকা রাখছে বলে তিনি মনে করেন।
