রফিকুল ইসলাম আধার

আমাদের সাবেক দুই প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে তত্বাবধায়ক সরকারের সাম্প্রতিক অবস্থান এবং উদ্ভূত অবস্থায় তা পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে ‘শিকেয় উঠা’ রাজনীতিতে এক ভিন্ন ও নতুন মাত্রার যোগ হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে সরকার যেমন জড়িয়ে পড়েছেন তুমুল বিতর্কে, ঠিক তেমনি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাদের স্থায়িত্ব, দায়িত্ব ও উদ্দেশ্য নিয়েও।
এ কথা সবার জানা যে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মেয়াদকালে আওয়ামী লীগ তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে তা মহা ঐক্যজোটে রূপ নেয়। পরবর্তীতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রাথমিক বিজয় হলেও জোটের ছকে সাজানো ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ এর নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক সরকার খোদ ‘কেয়ারটেকার কনসেপ্ট’কেই হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। যে কারণে নজিরবিহীনভাবে হলেও সেই তত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও চলতে থাকে অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি। সুতরাং পরিবর্তিত অবস্থায় গঠিত ড. ফখরুদ্দিন আহমদ এর নেতৃত্বে বর্তমান নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের ফসল বলেই সচেতন মহল মনে করেন। অথচ সরকার শেখ হাসিনাকেই ‘দেশের আইন-শৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ’সহ নানা অসংলগ্ন বিশেষণে আখ্যায়িত করে তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। শেখ হাসিনা দেশে থাকতে সরকারের কর্মকান্ডে সন্তোষ প্রকাশ করে কেবল তথাকথিত ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে তালগোল না পাকিয়ে ‘সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো’ বলার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়ে আসছিলেন এবং বিদেশ যাবার মুহূর্তে ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতায় গেলে বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দেবেন বলে মুক্ত প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন। অথচ বিদেশ যাবার পরপরই তার বিরুদ্ধে এজাহারে নাম না থাকা সত্বেও একটি হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল, ওই মামলায় পলাতক দেখিয়ে গ্রেফতারী পরোয়ানা, ২ মণ ওজনের (টাকা ও ব্রিফকেস সমেত) ৩ কোটি টাকার চাঁদাবাজীর মামলা এবং সর্বশেষ তার দেশে ফিরতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে বার্তা প্রেরণসহ ফেরত আসতে প্রতিবন্ধকতা নিশ্চিত করা হয়। দেশ থেকে বিদেশে অবস্থানের স্বল্পতম সময়ে শেখ হাসিনা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের মূল কারণ জানা না গেলেও মিডিয়ার মাধ্যমে অন্ততঃ একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, শেখ হাসিনা অর্থবহ সংস্কারের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে মিটিং, সমাবেশ, সেমিনার ও প্রবাসীদের সাথে সাক্ষাতকালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেইসাথে এমন অভিমতও ব্যক্ত করেছিলেন যে, দ্রুত নির্বাচন না হলে জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে।
অন্যদিকে সেনা ছাউনি থেকে বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতার মসনদে আরোহনকারী জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া ‘ভাঙ্গা স্যুটকেস ও ছেড়া গেঞ্জী’ সম্বলধারী পরিবার প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এতিম দুই পুত্রসহ সেনা সংরক্ষিত এলাকায় দীর্ঘ বসবাস ও দুই দুইবার প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ এবং সেইসুবাদে দেশে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’র মা বনে গিয়ে তত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকান্ডে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চুপচাপই থেকে যাচ্ছিলেন। বুকের মানিক তারেককে বুক ছাড়া করলেও তার মুখ থেকে টু শব্দটিও বের হয়নি। অথচ খালেদা জিয়ার চলাচলেও সতর্কাবস্থা, নেতাদের সাথে সাক্ষাতে বাধা-নিষেধ ও বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণসহ এক পর্যায়ে দ্বিতীয় পুত্র আরাফাতকে ‘আটক নাটক’ এর পর তাকে দেশের বাইরে পাঠাতে অঘোষিত তত্পরতা শুরু হয়।
দুই নেত্রীর ওই নির্বাসন পরিকল্পনায় রাজনৈতিক সচেতন মহল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। বিষয়টিকে পাকিস্তানের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোর পরিণতি সৃষ্টি বা পাকিস্তান স্টাইল স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তনের প্রয়াস বলে আখ্যায়িত করে বিশ্লেষকদের মাঝে কেবল মৃদু গুঞ্জনই উঠেনি, দেশের আয়তন ছাপিয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গণেও তার প্রভাব পড়ে। খালেদা জিয়ার তরফ থেকে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল এবং শেখ হাসিনার তরফ থেকে রিট পিটিশন দাখিলের প্রস্তুতি শুরু হয়। দুই নেত্রীর নির্বাসন প্রক্রিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তত্বাবধায়ক সরকারকে জানিয়ে দেয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আবারও হুমকির মুখে পড়বে। সেইসাথে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বৃটেনসহ কয়েকটি প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ব্রিটিশ এমপিদের তরফ থেকে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান হিসেবে দেখতে চাই না’। আর তাদের ওই অভিমত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সরকারের ওই সিদ্ধান্ত বিশেষ উদ্দেশ্যে না হলেও অন্ততঃ ভুল ছিল বা সঠিক ছিল না। সঙ্গত কারণে সরকার দেশের জনগণ ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে দুই নেত্রী সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান গুটিয়ে নেয়। সরকারের বেহিসেবী নির্বাসন পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। যে কারণে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক হত্যা মামলায় চার্জশীট দাখিল করেও পরবর্তীতে পলাতক দেখিয়ে আদালতের ইস্যুকৃত ওয়ারেন্ট কেবল স্থগিতই করা হয়নি, ওই মামলায় তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অধিকতর তদন্তেরও আদেশ হয়। এমনকি চকিতভাবে দৃশ্যপট এতটাই পাল্টে যায় যে, সরকার শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে অঘোষিত চাপ প্রয়োগের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য চলাচলে বাধা দূর করেন।
‘আইনের উর্ধ্বে কেউ নন’- এই ধ্রুব সত্য ও বাস্তবতাকে স্বীকার করেই বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কারও স্বাচ্ছন্দ্য চলাচলে বাধা-নিষেধ গণতন্ত্রের যথার্থতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। সুতরাং কোনো নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য চলাচলে বাধা অর্থ্যাৎ জন্মগত অধিকার ক্ষুন্ন করে তাকে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা যেমন আইন ও সংবিধান পরিপন্থী, ঠিক তেমনি তা জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বৈকী ?
তবে এ কথাও সত্য যে, গণতন্ত্রের ঊষালগ্নে বাংলাদেশে এক চরম ক্রান্তিকালে পরিবর্তিত অবস্থায় ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার যাত্রা শুরু করে। যে কারণে দায়িত্ব ও স্থায়িত্বের নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের আশা-আকাঙ্খাতাড়িত জনগণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, কালো টাকাসহ সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদেরকে আইনের দ্বারস্থ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতি এবং সৎ, যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের সামগ্রিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপকে ইতিবাচক দিক বলেই সমর্থন ও অভিনন্দন জানিয়ে আসছিলেন। সঙ্গত কারণে সচেতন মহল আরও আশান্বিত ছিলেন- যেন সংস্কারের জন্য সংস্কার না হয়, সংস্কার যেন হয় অর্থবহ। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দীর্ঘ একশ দিন অতিবাহিত হলেও খালেদা-হাসিনা বৃত্তান্তের বাইরে মূল দায়িত্ব ও নির্বাচন প্রক্রিয়া কতটুকুইবা অগ্রসর হয়েছে ? চিহ্নিত ও বহুল আলোচিত জঙ্গী মদদদাতা, কালো টাকার মালিক ও গডফাদাররাই বা ক’জন গ্রেফতার হয়েছেন ? জোটের ছকে সাজানো প্রশাসনের সচিব পর্যায়ে রদবদল হলেও জেলা পর্যায়ে মূখ্য কর্ণধার হিসেবে চিহ্নিত দলীয় আনুগত্যের অনেক ডিসি-এসপি-ইউএনও টার্গেট পয়েন্টেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ক্রেডিট নেবার জন্যই হোক বা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যই হোক, নন প্রাকটিশনার ব্যারিষ্টার আইন উপদেষ্টার তত্পরতায় রাতারাতি বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। আপিল বিভাগে নয়া বিচারপতি অন্তর্ভূক্তির প্রায় দুই মাস পরও সদ্য সাবেক জোট সরকারের ডিপফ্রিজে রাখা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পরবর্তী কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। ঢাক-ঢোল পেটালেও দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত কয়েকশ আইন কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল এবং সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তার নিয়োগ এখনও হয়নি। … বিচারপতি ফায়েজীর সার্টিফিকেট কেলেংকারীর আইনগত নিস্পত্তির বিষয়টি আজও ঝুলে আছে। সর্বোপরি শুরু হয়নি সর্বোচ্চ আদালতে কোন শুদ্ধি অভিযান। অথচ বিশেষতঃ নব্বইয়ের গণআন্দোলন পরবর্তী সময় থেকে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রীম কোর্টে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য ও অদক্ষ বিচারপতি নিয়োগ ও অনিয়ম যেভাবে হয়েছে- তাতে বিচারিক কাজে যেমন শৃঙ্খলা নেই, ঠিক তেমনি বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। সেইসাথে মানুষ হারিয়েছে বিচার বিভাগের প্রতি পূর্ণ আস্থা। আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রধান বিচারপতি রহুল আমিনের সাম্প্রতিক তোলপাড় সৃষ্টিকারী বক্তৃতায় সর্বোচ্চ আদালতের ওই দৃশ্যপট ফুটে উঠলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের তত্পরতাই বা কতটুকু রয়েছে ?
তথাপি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ অর্থনীতির চাকা সচলকরণ ও প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ-সার সংকটের মতো জটিল বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগায়- এ কথা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। কেবল তাই নয়, পরিবতির্ত অবস্থায় আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে ‘বস অব দি বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করে সচিত্র প্রচ্ছদ, নিবন্ধ পর্যন্ত ছাপা হয়। সুতরাং দেশে ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে সরকার সর্ম্পকে একটা স্বচ্ছ ও প্রবল আশা জাগানিয়া মনোভাবের সৃষ্টি হয়। দেশের আকাঙ্খাতাড়িত জনগণ তাকিয়ে থাকে গণতন্ত্রের সুবাতাস অচিরেই ফিরে আসবে বলে। কিন্তু হঠাৎ করেই দুই প্রধান শীর্ষ নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানোর বেহিসেবী পরিকল্পনায় তত্বাবধায়ক সরকার ও জনগণের মাঝে এক বিরাট অবিশ্বাসের কালো ছায়া নেমে আসে। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার শিকার এ দেশের ভাগ্যাহত মানুষ যেমন সুষ্ঠু রাজনীতি প্রত্যাশা করে, ঠিক তেমনি রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়নকে সমর্থন করে না বলেই এখন তারা সংস্কারের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে আছেন। কিন্তু তাই বলে সংস্কারের নামে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রীকেই অপসারণ করে নির্বাসনে পাঠাতে হবে- এমন প্রত্যাশা রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরাসহ সচেতন মহলও পোষণ করেন না। কারণ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উভয়েই যথাক্রমে দেশের রাষ্ট্রপতি ও দলের প্রধান পিতা এবং স্বামী নিহত হবার পর দলের নেতা-কর্মীদের পীড়াপীড়িতে দুর্দিনে দলের অস্তিত্ব ও ঐক্য রক্ষার্থেই রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। দুই নেত্রীর মধ্যে খালেদা জিয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও শেখ হাসিনা ছাত্রাবাস থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের পারিবারিক উত্তরাধিকার বা উভয় দলে পরিবারতন্ত্রের ধারায় দৌরাত্মের অভিযোগ উঠলেও তা শতভাগ সত্য নয়। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও জনবিচ্ছিন্ন নেতা ক্ষমতার স্বাদ পেতে জাতীয় সরকারের ফর্মূলা মাথায় নিয়ে চুপচাপ থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত হচ্ছে, পারিবারিক বৃত্তের ভাঙ্গনসহ দলের সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে তা দুই নেত্রীর নেতৃত্বেই করতে হবে। তা না হলে ওই বৃত্ত ভাঙ্গন তো দূরের কথা, সংস্কারেও হাত দেয়া যাবে কিনা- তা নিয়ে প্রায় শতভাগই সংশয় রয়েছে। তদুপরি পরিবর্তিত অবস্থার মাঝেও দেশে বিকল্প কোন গণতন্ত্রের মানসপুত্র বা মানসকন্যার আবির্ভাব ঘটেনি এবং জনগণের মাঝে মিশে না থেকে হঠাৎ আমদানীকৃত ডিগ্রী নিয়ে দেশে আবির্ভূত কাউকে জনগণ সহসাই মেনে নেবেন- এমন আশা করাটাও কেবল দুরাশাই হবে না, রীতিমত তা আহাম্মকের ল্যামনচুস চিবানোর সমান্তরাল হবে বৈকী ?
সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের অধ্যায়কে সচেতন মহল ‘জনগণের জয়’ বলে অভিহিত করেছেন। আর এই অবস্থায় প্রায় ত্রিশ কোটি চকিত দৃষ্টি যখন সরকারের দিকে তাকিয়ে, ঠিক তখন সরকারের তরফ থেকে মিডিয়ার সামনে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন খোদ সরকারকেই রীতিমত বিতর্কে জড়িয়ে ফেলেছেন। কারণ ভুলকে সরাসরি ভুল বলেই স্বীকার না করে যতোটা কৌশলেই ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন, তা হবে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র কৌশল মাত্র। তদুপরি সরকারের তরফ থেকে দেয়া ওই ব্যাখ্যা পর্যালোচনায় প্রকারান্তে তা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলেই বিশ্লেষকদের মত প্রকাশিত হয়েছে। যে কারণে যাত্রা থেকে শুরু করে দুই নেত্রীর নির্বাসনের পরিকল্পনাপূর্ব পর্যন্ত সরকার যে পর্বতপ্রমাণ প্রশংসনীয় অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়- তা হঠাৎ করেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ সরকার তা উপলব্ধিতে না নিয়ে এবং ওই ভুল সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত না করে উল্টো মুখপাত্র ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের মুখ দিয়ে ‘দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানোর পরামর্শ রাজনীতিবিদরাই দিয়েছেন’- এম তথ্য প্রকাশ করে খোদ সরকারকেই তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে ফেলেছেন। এছাড়া ছাত্র রাজনীতির ওপরও অযাচিত মন্তব্য করায় ছাত্র-শিক্ষকরাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পাশাপাশি ফুসে উঠছেন। আর তথ্য উপদেষ্টার ওই তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শীর্ষ নেতারা যেমন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তা প্রত্যাখানও করে বসেছে। এমনি অবস্থায় ‘অরাজনৈতিক সরকারের সাথে কোন রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক থাকে না বা থাকতে পারে না’ বলে মন্তব্য প্রকাশ করে বিএনপির সাম্প্রতিক আলোচিত মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) হান্নান শাহ উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইস্পাত কঠিন ও নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কেও খোলা মন্তব্যের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে (!) এবং তা হচ্ছে সরকারের বেহিসেবী পরিকল্পনা ও বেসামাল মন্তব্যের কারণেই।
আমাদের স্মরণে আছে যে, ‘ব্যানা হুদা’ আর ‘সাকা চৌ’ বলে আলোচিত দুই নেতা বেফাস মন্তব্য করে নানা সময়ে দেশে বিতর্কের ঝড় তুলেন। সুতরাং পরিবর্তিত অবস্থায় ওই একই ধরনের মন্তব্য শুনতে অভ্যস্থ নয় সচেতন মহল। তারপরও যদি ‘ব্যানা হুদা’ ও ‘সাকা চৌ’ বচন শুনতে হয় তবে ‘এখনই সময়’ এর চমত্কার শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ সচেতন মহল আশান্বিত না হয়ে থমকে দাঁড়াবেন- এটাই স্বাভাবিক। সেইসাথে সচেতন মহলে সরকারের ভবিষ্যত কর্মকান্ড নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা দুটোই যে বাড়ছে, তা বলার অবকাশ রাখে না। সুতরাং কেবল সংস্কারের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত না করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই বাঞ্চনীয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন। দুই শীর্ষ নেত্রীর দাবিও এখন দ্রুত নির্বাচন, যাদের প্রতি দূর্বল দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ জনতা। সঙ্গত কারণে বিবেচনায় নিতে হবে জনগণের ধৈর্য্যরে বিষয়টিও। অর্থ্যাৎ সাম্প্রতিক পটভূমিতে জনগণ ও সরকারের মাঝে অবিশ্বাসের যে জাল তৈরি হয়েছে- তা নেহায়েতই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এ অবিশ্বাস যতই দীর্ঘস্থায়ী হবে- দেশের জন্য দেশের আকাঙ্খাতাড়িত মানুষের জন্য তথা উদীয়মান গণতন্ত্রের জন্য তা ততোই বিপদ সঙ্কেত বয়ে নিয়ে আনবে। সুতরাং ‘সাময়িক সিদ্ধান্ত’ পরিবর্তনে সাহসী সরকারকেই এ সৃষ্ট অবিশ্বাস নামক কালো মেঘ দূর করতে হবে। আর ভুলকে ভুল বলেই স্বীকার না করে পাল্টা বা খোড়া যুক্তি দেখিয়ে ‘ব্যানা হুদা’ ও ‘সাকা চৌ’র মত বেফাস মন্তব্য ছোড়ে অযথা বিতর্ক বাড়িয়ে কঠিন ও মূল্যবান সময় অপচয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা না হলে আশা পরাহত জাতিকে আবারও এক ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে বৈকী ? সেইসাথে সময়ের বাতাসে আজকের সাবেক প্রধামন্ত্রীদের মতো খোদ তত্বাবধায়ক সরকারকেই হয়তোবা জনতার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তখন আর আশ্চর্য হবার মতো কিছু থাকবে না। সুতরাং মিনতি ঃ প্লিজ, ‘বস অব দি বাংলাদেশ’। প্লিজ, তত্বাবধায়ক সরকার বাহাদুর। প্লিজ, দেশের স্বার্থে আর বিতর্কে জড়াবেন না।

লেখক : সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিক, শেরপুর। ই-মেইলঃ press.adhar@gmail.com
