এস.এম আজিজুল হক, পাবনা : ঈশ্বরদী ও বেড়া উপজেলাসহ গোটা পাবনায় মৃৎ শিল্পে চলছে দুর্দিন। এক সময় মৃৎ শিল্পের কদর ছিল দেশ জুড়ে। এখন আর কেউ মৃত্তিকা শিল্পের দিকে ঘুরে তাকায় না। অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত কারিগর ও শ্রমিকদের। অনেকে বাপ-দাদার পৈত্রিক ব্যবসার ঐতিহ্য হিসেবে ধরে আছে এই পেশা। নতুনভাবে এই শিল্পে কেউ আসছে না। অনেকে বাপ-দাদার এই পেশাকে ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে তরুনেরা বেশির ভাগ এই পেশা ছেড়ে রিকসা, ভ্যান, ভুটভুটি চালক হয়েছে। কেউ বা কৃষি কাজে এবং নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছে।
যেমনি বেড়েছে শ্রমিকের মূল্য তেমনি মাটি ও খড়ির মূল্য বেড়েছে। আগে দেখা যেত প্রতিটি বাড়িতে মাটির তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহৃত হত। বর্তমানে শতকরা এক-দুই বাড়িতে তা পাওয়া মুশকিল। প্লাষ্টিক, এ্যালুমিনিয়াম, ষ্টিলের তৈজসপত্রের বাজারে টিকতে পারছে না মৃৎ শিল্পের আসবাব পত্র। মাটির তৈরী জিনিস ভেঙ্গে যায় এবং সেই সাথে বর্তমান সমাজে খাপ খাইয়ে চলা দায়। রহিম উদ্দিন নামের ৯৩ বছরের একজন বয়স্ক ব্যক্তি জানান, মাটির তৈরী হাড়ির রান্না এ্যালুমিনিয়াম, ষ্টিলের পাত্রের চাইতে খাবার হয় সুস্বাদু। তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা দেখেছি মাটির তৈরী জিনিসের কত কদর। পালদের পরিবারে ছিল স্বচ্ছতা আনন্দে কাটতো তাদের সংসার জীবন। বর্তমানে পালদের অবস্থা খুব খারাপ ও শোচনীয়। অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে তাদের দিন। পুষ্টিহীনতায় ছেলে-মেয়েরা রোগে শোকে ভুগছে। পড়াশুনা থেকে ওরা বঞ্চিত তিন বেলা খাবার জোটেনা পড়াশুনা করাবে কিভাবে ?
সরেজমিনে পাল পরিবারের করুন চিত্র দেখলে চোখে জল চলে আসে। ঈশ্বরদী উপজেলার আড়ামবাড়িয়া ও মুলাডুলির এ দুটি পালপাড়া রয়েছে। এখন তারা গরু খাওয়ানো চারি, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক যৎসামান্য তৈরী করে থাকেন। মৃৎ শিল্পের মালামাল বিক্রেতা শ্রী অসিত কুমার পাল বলেন, এখন সকলেই ব্যাংক কিংবা সমিতি করে, তাই মাটির ব্যাংকে টাকা রাখেনা। সে কারণে খুব কম চলে। তিনি বলেন, বৈশাখ এলে কিছু মাটির সানকি বিক্রি হয়। এছাড়া বাকি সময় দোকানে অলস পড়ে থাকে এসব মাটির তৈরি সামগ্রী।
ঈশ্বরদী আড়ামবাড়িয়া পালপাড়ায় সরেজমিনে গেলে তাদের করুন চিত্র ফুটে ওঠে। শ্রী মঙ্গল কুমার পাল (৭৯) জানান, বাপ-দাদার পেশা, তাই ধরে রেখেছি। মাটির কাজ আগের মতো নেই। সেই সাথে মাটির অনেক মূল্য বেড়েছে আগে নদী থেকে মাটি এনে কাজ করেছি। তিনি আরও বলেন, এখন কেউ নতুন ভাবে এই পেশায় আসছে না। কোন জিনিস বেশি চলে জানতে চাইলে বলেন, দইয়ের হাড়ি, গরুকে খাওয়ানোর চারী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক বেশি চলে। পালপাড়ার অবস্থা অনেকাংশে খারাপ, আধুনিকতার সাথে খাপ খাইয়ে চলা মুশকিল।
সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জার্জিস হোসেন বলেন, এই ইউনিয়নে উপজেলার সবচেয়ে বেশি পালদের বসবাস ছিলো। নদী ভাঙ্গনের কারণে তারা বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে। এক সময় আড়ামবাড়িয়ার তৈরী মাটির সামগ্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হতো। আধুনিকতার কাছে মাটির তৈরী সামগ্রী পাত্তা পাচ্ছেনা। মাটির তৈরী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এদিকে বেড়া উপজেলার মালদাপাড়ায় এখনও বেশ কয়েক ঘর পৈত্রিক পেশা আকড়ে ধরে বাঁচার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানকার পালেরা ভিটেমাটি হারিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়ে কোনোরকমভাবে মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছে। হাটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাপ্তাহিক এ যুগের দীপ পত্রিকার সম্পাদক সরকার আরিফুর রহমান বলেন, এই ইউনিয়নে হাজার হাজার পালের বসবাস ছিল। নদী ভাঙ্গন ও মাটির তৈজসপত্রের কদর কমে যাওয়ায় তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বাপ দাদার পেশা আকড়ে ধরে।