এস.এম আজিজুল হক পাবনা : শারদীয় দুর্গোৎসবের পরেই এবারের কোরবানীর ঈদের পরদিন থেকে পর্যটন কেন্দ্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ীতে দর্শনার্থীদের ভীড় উপচে পড়েছে। ঈদোৎসব উদযাপনে শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সেরই বিনোদন পিয়াসু দর্শনার্থীদের পদচারনায় ও মিলনমেলায় মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে উঠেছে কাচারিবাড়ী প্রাঙ্গন। সেই সাথে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর প্রাঙ্গন, বড়াল সেতু ও করতোয়া সেতুতেও পরিবার পরিজন নিয়ে শত শত দর্শনার্থীরা প্রাকৃতিক পরিবেশ অবলোকন ও ফুসফুসটা রিচার্জ করে ঘরে ফিরছেন।
শনিবার বিকেলে কবিগুরুর কাচারিবাড়ী পরিদর্শনকালে বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীদের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। আলাপকালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার দাড়িয়াল ইউনিয়নের বামনিকাঠী গ্রামের যুবদলের মো. জসিম উদ্দিন হাওলাদার জানান,‘ ঊণবিংশ শতাব্দিতে বাংলা সাহিত্য গগণে ও বিশ্বের জ্ঞান পরিমন্ডলে ভারস্যাটাইল জিনিয়াসখ্যাত (বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুরের কাছাড়িবাড়ী পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা বহুদিনের। কিন্তু সময়ের অভাবে সেই সাধ ইতিপূর্বে পূরণ হয়নি। এদিন কবিগুরুর শাহজাদপুরের কাছাড়িাবাড়ী ঘুরে বিশ্বকবির স্মৃতির স্পর্শ পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। এখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, আসবাবপত্র ও চিত্রকর্মের সমাহারে সৃষ্ট রবীন্দ্র স্মৃতি যাদুঘর ঘুরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’
জানা যায়, শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ী রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৩ তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারী এককালে নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারী নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় ওই জমিদারী কিনে নেন। জমিদারীর সাথে সাথে ওই কাচারিবাড়ীও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আগে কাচারিবাড়ীর মালিক ছিল নীলকর সাহেবরা। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সম্ভবত এ কারনেই শিলাইদহে তাঁর বাসগৃহ কুঠিবাড়ী নামে এবং শাহজাদপুরের বাড়িটি কাচারিবাড়ী নামে পরিচিত। শাহজাদপুরে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পালকিতে , নৌকায় ও পায়ে হেটে। শাহজাদপুর শহরের প্রানকেন্দ্র দ্বারিয়াপুর বাজারে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহত কাপড়ের হাটের দক্ষিণ পাশে এক সবুজ শ্যমল পরিবেশে কাচারিবাড়ী অবস্থিত। শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ী ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার এবং উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির দ্বোতলার সিড়ি ব্যতীত মোট ৭টি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির উত্তর দক্ষিনে একই মাপের প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দার গোলাকৃতির জোরামাপের খাম, উপরাংশে আছে অলংকরণ করা বড় মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের ওপরে প্যারাপেট দেয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম দর্শনাথীদের বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ছে। ভবনটির জানালা দিয়ে চারপাশের মনোরম, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কবি উপলব্ধি করতেন। কাছারিবাড়ীতে বসেই কবি প্রাণভরে ছোট নদী দেখতেন ও শুনতেন ছোটনদীর স্রোতধারার মিশ্রিত সুর।
শাহজাদপুরে এসে মানুষ ও প্রকৃতিকে কবি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন। এখানে তিনি খুজে পেয়েছিলেন সাহিত্য সৃষ্টির নানা উপাদান। এখানে অবস্থানকালে তিনি রচনা করেন, সোনারতরী , বৈষ্ণব কবিতা, দুটি পাখি , আকাশের চাঁদ, পুরস্কার , যমুনা, হৃদয়, ভরা ভাদরে, প্রত্যাক্ষান ও লজ্জা, চিত্রা, শীত ও বসন্তে, নগর সংগীত, নদীযাত্রা, মৃত্যুমাধুরী, স্মৃতি বিলয় , প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন,যাত্রী, তৃণ, ঐশ্বর্য, স্বার্থ, প্রেয়সী, শান্তিময়, কালিদাসের প্রতি, কুমার, মানষলোক, কাব্যপ্রার্থনা, ইছামতী নদী, সুশ্র“সা, অশিক্ষা গ্রহন, বিদায়, নববিবাহ, রজ্জিতা, বিদায়, হতভাগ্যের গান, গতোনিক, বঞ্চনা, সংকোচ, মানষ প্রতিভা, রামকানাইয়ের, নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারা প্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সম্পত্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, ইত্যাদি। এছাড়া কবিগুরু এখানে অবস্থান করে ৩৮ টি বিভিন্ন ছিন্ন পত্রাবলী। পঞ্চভূতের অংশবিশেষ ও নাটক বিসর্জন রচনা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রতœতত্ব্ অধিদপ্তর কর্তৃক অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় কাছাড়িবাড়ীকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষনা করা হয়। ওই কাচারিবাড়ীর মূল ভবনটির নানা সংস্কার কাজ সমাপ্ত করে ভবনটিতে রবীন্দ্রভিত্তিক আলোকচিত্র ও এ বাড়িতে কবির ব্যবহৃত প্রাপ্ত আসবাপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি যাদুঘরের রূপ দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে ওই যাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। নিচতলা ও দ্বোতলার বিশাল হলরূমসহ যাদুঘরের সকল কক্ষ সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। চারদিকে পাঁকা দেয়ালে বেষ্ঠিত কাচারিবাড়ীর আঙ্গিনাটিও বেশ বড়। এখানে রয়েছে রবীন্দ্র মিলনায়তন, কবির ব্যবহৃত সামগ্রীর মধে চৌকি, লেখার জন্য ডেস্ক, সোফাসেট, আরাম কেদারা, আলনা, আলমারী, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, ওয়াটার ফিল্টার, ল্যাম্প, কবির স্বহস্তে আঁকা ছবি, দেশী বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানীসহ গুনিজনদের সাথে কবির অগনিত ছবি। ঈদের পরবর্তী সময়ের সবোর্চ্চ সদ্ব্যবহার করতেই এবং কবিগুরুর ওইসব স্মৃতির পরশ পেতেই এখানে বরিশালের যুবদলের জসিম উদ্দিন হাওলাদারের মতো অগণিত দর্শনার্থীদের ভীড় উপচে পড়ে। অপরদিকে, বিনোদন পিয়াসু দর্শনার্থীরা ঈদের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর প্রাঙ্গন, বড়াল ও করতোয়া সেতুতেও প্রকৃতির একটু শীতল স্পর্শ পেতে ভীড় জমায়।
