বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ-বিশেষজ্ঞদের আলোচনা-সমালোচনা, নানা দিক-নির্দেশনা কোন কিছুই কাজে আসছে না। একদিকে সরকার, অন্যদিকে মালিকপক্ষের আশ্বাস, প্রতিশ্র“তির ফুলঝুরি সবই যেন গুড়েবালি। তাজরিন ফ্যাশন, রানা প্লাজা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কারখানা আগুনে ও ভবনধ্বসে সস্তা শ্রমিকের মৃত্যুসহ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছে চলতি বছরে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অবহেলা, অসাবধানতা, নির্মাণত্র“টি, পুরাতন সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে আবারও পলমল গ্র“পে পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে ৭ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়েছে।
দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে সস্তা শ্রম বিক্রি করতে ছুটে আসা প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোকে আর কতদিন এভাবে জীবন দিতে হবে? জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের যুগেও নির্মাণ ত্র“টি, ভবন নির্মাণে নিু মানের সামগ্রী ব্যবহার, ফায়ার সার্ভিসিং ব্যবস্থার অভাব, পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, উঠানামার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত সিড়ি তৈরিতে কর্তৃপক্ষের অনিহা, নানাবিধ সমস্যা নিয়েই প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠা লাভ করছে শতশত শিল্প কারখানা। এক্ষেত্রে প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তি, অসুস্থ্য রাজনৈতিক ধারা সহজেই বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ অবস্থায় হরহামেশাই অগ্নিকান্ডের ঘটনা, কখনওবা ভবনধ্বসের মত ঘটনায় হাজারও পোশাক শ্রমিকের জীবন সংহার ঘটলেও রাষ্ট্র, সমাজ সবাই যেন নির্বিকার। শ্রমিক মানেই কি অমানবিক অস্বাভাবিক মৃত্যু ? বিজ্ঞানের প্রসার, ব্যবহার ও ডিজিটালাইজড এ যুগেও বিষয়টিকে আমরা কি নিছক দূর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে পারি ? আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে আগুনে পুড়ে ১শ ১২ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস ব্যবধানে সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে ১ হাজার ৩২ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ হাজার হাজার শ্রমিক অঙ্গ হারিয়ে বেকারত্বের অভিশাপে তিলে তিলে পুড়ে মরছে। ওই ট্র্যাজেডির দগদগে ক্ষত না শুকাতেই আবারও ঘটল আগুনে পুড়ে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা। এবার ঘটনাস্থল গাজীপুর আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লি:। তাজরিন ফ্যাশন, রানা প্লাজার হাজারও শ্রমিকের মৃত্যু সারা দুনিয়াকে ভাবিয়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা কত অবহেলা অযতেœ অমানবিক পরিবেশে কাজ করেন, এদেশের শ্রমিকের জীবন কত মূল্যহীন, এসব শিল্প কারখানার মালিকরা কতটা নিচু মানসিকতার দায়িত্ব-কান্ডহীন, অর্থলোভী, মূর্খ হতে পারে এসব বিষয় বিশ্ব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বর্তমানে দেশের শ্রম পরিবেশ ও শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকারের বিষয়টি আর্ন্তজাতিকভাবে অসামান্যই সমালোচনার মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোষাক বর্জনের জন্য আর্ন্তজাতিক ক্রেতাদের ওপর চাপও সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে । শ্রমিকদের যথাযথ কর্মপরিবেশ ও অধিকার আদায়ে চাপ দিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানীর বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা (জিএসপি) প্রথা বাতিল করেছে। বর্তমানে শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ যথাযথ বলে দাবি করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সরকার জিএসপি ফেরত পাবার আশায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেন-দরবার করে আসছে। নানা পদক্ষেপের কথাও শুনাচ্ছে পোশাক শ্রমিক তথা সমগ্র দেশবাসীকে।
ঠিক তখনই আসওয়াদ গামের্ন্টেসে আগুন লাগার ঘটনা অনেকটা নেতিবাচক হিসাবে বিবেচিত হবে বৈ কী ? সদ্য পলমল গ্র“পের আসওয়াদ কম্পোজিটে আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণ করে ২০১৩ সালে পোশাক কারখানায় দু’টি বড় বেদনাবিধূর ঘটনাও পোশাক কারখানার মালিকদের হীনমন্যতার উন্নতিতে আচড় কাটতে পারেনি। ওইসকল ঘটনারোধে সরকার তথা মালিক সাহেবরা দায়িত্ব কর্তব্যের অবহেলা ও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। মূলত: শ্রমিকের জীবন মূল্যহীন ভাবার হীনমন্যতাই ওই দায়িনত্বহীনতার একমাত্র কারণ নয় কী? হাজারও শ্রমিক ভবনধ্বসে চাপা পড়ে আগুনে পুড়ে মারা গেলেও মালিক পক্ষের দায় নিতে হয় না। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়না। যতদিন ওইসব অনাকাঙ্খিত ঘটনায় শ্রমিকের জীবন সংহারের দায় কারখানা মালিকদের নিতে হবেনা, ততদিন ওই সৃষ্টাবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিল্পখাতে শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতার পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা আশা করছি পলমল গ্র“পের আসওয়াদ কম্পোজিট কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। আগুন লাগার কারণ হিসেবে কোনরকম অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় যাতে না নেওয়া হয়, কর্তৃপক্ষের অবহেলা, গাফিলতি, নির্মাণত্র“টি, নিুমানের সামগ্রী ব্যবহার ধরা পড়লে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প, রপ্তানীর বাজার ও সুনাম। হ্রাস পাবে অস্বাভাবিক শ্রমিক মৃত্যুর হার।

লেখক : সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বার্তা সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম।
