শ্যামলবাংলা ডেস্ক : বিমানবন্দর থেকে গণভবন। দীর্ঘ ১৪ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ যেন জনারণ্য। জনতার ঢল নেমেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে। ফুল ছিটিয়ে, বাদ্য বাজনার তালে স্লোগানে স্লোগানে মানুষ বরণ করে নিয়েছেন প্রিয় নেত্রীকে। জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে যোগদান শেষে দেশে ফেরার পর শনিবার এভাবেই হাজার হাজার মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। গণভবনেও দেশের বিশিষ্টজনদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিতে মানুষের এই বিপুল ভালোবাসায় উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছেন, ‘এই অর্জন জনগণের। জনগণের প্রাপ্য এই পুরস্কার। দুইটি পুরস্কারই পুরো জাতির ও দেশের জন্য সম্মানের।’
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের বিস্তারিত তুলে ধরতে রবিবার সকাল সাড়ে ১১টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনও করবেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ ও আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ পাওয়ায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাপক সংবর্ধনার এই কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল শনিবার দুপুর দেড়টায়। এরও অনেক আগে সকাল ১১টা থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সমবেত হয় মানুষ। রাজধানী ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাভার এবং আশুলিয়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম ও সমমনা সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়ো হন সংবর্ধনার ৮ রুটে।
এমপিদের নেতৃত্বেও ছিলেন বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে ছিলেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতি কর্মী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট; হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্ট্রান ঐক্য পরিষদ; পূজা উদযাপন পরিষদ; নারী সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষও। জাতীয় ও দলীয় পতাকা এবং ব্যানার-ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও বেলুনসহ ফুল হাতে সমবেত এসব মানুষ দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকেছেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। রাস্তার দুই পাশে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরে বড় বড় বিলবোর্ড ও ব্যানার শোভা পায়। আর প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে সমবেত মানুষ গান ও বিভিন্ন বাদ্য-বাজনার পাশাপাশি স্লোগানে মুখর রাখেন গোটা এলাকা। মাইকে বাজে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রেরণামূলক দেশাত্ববোধক গান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণভবনমুখি সড়ক জনারণ্যে পরিণত হয়। মানুষের ভিড়ে বেলা ১২টা থেকে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে তীব্র দুর্ভোগেও পড়তে হয়।
ওই অবস্থায় লন্ডন থেকে সিলেটে এসে যাত্রাবিরতির পর দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-০০২ ফাইটটি ঢাকার হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সোয়া ১টায় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও ঢাকা সিটির মেয়রসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রীকে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন শেখ হাসিনা। ওইসময় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ নাসিম, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, এইচটি ইমাম, তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আ হ ম মোস্তফা কামাল, নূরুল ইসলাম নাহিদ, ফারুক খান, আবদুল মতিন খসরু, এ বি তাজুল ইসলাম, অসীম কুমার উকিল, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান খান কামাল, মির্জা আজম, জুনাইদ আহমেদ পলক, নসরুল হামিদ বিপু, তারানা হালিম, ইসমত আরা সাদিক, মেহের আফরোজ চুমকি, আনিসুল হক, আবদুস সহীদ এবং আসম ফিরোজ প্রমুখ।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা দেড়টায় গণভবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন শেখ হাসিনা। এ সময় জনতা বাধভাঙা উচ্ছ্বাস ও করতালিতে স্বাগত জানান তাকে। তারা ফুল ছিটিয়ে ও বেলুন উড়িয়ে অভিনন্দিত করেন প্রিয় নেত্রীকে। তাদের কণ্ঠে ছিল, ‘শেখ হাসিনার জন্য, বাংলাদেশ ধন্য’, ‘যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা, শেখ হাসিনা শেখ হাসিনা’, ‘জামায়াত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’সহ নানা স্লোগান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার গাড়িবহর নিয়ে ধীরে ধীরে সড়ক অতিক্রমকালে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান মানুষকে। পথে পথে মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছায় সিক্ত প্রধানমন্ত্রী দুপুর সোয়া ২টায় পৌঁছান গণভবনে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা শেখ হাসিনাকে গণভবন পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে আসেন। এছাড়া সংবর্ধনার বিভিন্ন রুটে নেতৃত্ব দিয়েছেন দিলীপ বড়ূয়া, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, শিরীন আখতার, নূরুর রহমান সেলিম, একেএম রহমত উল্লাহ, সাবের হোসেন চৌধুরী, কামাল আহমেদ মজুমদার, হাজী মো. সেলিম, হাবিবুর রহমান মোল্লা, শেখ ফজলে নূর তাপস, সানজিদা খাতুন, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, আসলামুল হক আসলাম, জাহিদ আহসান রাসেল, এনামুর রহমান, হাবিবে মিল্লাত, এসকে সিকদার, অসীত বরণ রায় এবং ইসমাইল হোসেন প্রমুখ।
গণভবনে উষ্ণ অভ্যর্থনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে পৌঁছলে তাকে বরণ করে নেন বরেণ্য লেখক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, ক্রিকেটার, এভারেস্টজয়ী, চিত্র পরিচালকসহ দেশের বিশিষ্টজনরা। ফুল দিয়ে একে একে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শিল্পী হাশেম খান, রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, জাতীয় ক্রিকেট ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ, এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম ও নিশাত মজুমদার, পরিবেশকর্মী ইকবাল হাবিব, চিত্র পরিচালক আশরাফ শিশির প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রী গণভবনের মূল ফটকে পা রাখতেই রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তাকে আলিঙ্গন করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর তোলেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’ উপস্থিত অন্য বিশিষ্টজনরাও তার সঙ্গে খালি গলায় গেয়ে ওঠেন, ‘মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে/বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে/গ্রহতারা চন্দ্রতপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে/করিছে পান, করিছে স্থান, অয় কিরণে।’ এ সময় গান আর মুহুর্মুহু আনন্দধ্বনিতে মুখরিত হয় গোটা গণভবন।
এমনই উষ্ণ অভ্যর্থনা আর মায়াবী ভালোবাসায় আবদ্ধ প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর বলেন, ‘এই অর্জন জনগণের। জনগণের প্রাপ্য এই পুরস্কার। দুইটি পুরস্কারই পুরো জাতি ও দেশের জন্য সম্মানের।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী গণভবনের সভাকক্ষে গিয়ে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ কতোটা এগিয়ে যাচ্ছে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এই দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন।’ হাশেম খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কেবল দেশের জন্য নয়, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করছেন। তার এই পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাদের জন্য আনন্দ ও অহংকারের বিষয়।’ রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, ‘শেখ হাসিনার এই সম্মাননা জাতি হিসেবে আমাদের আরও গৌরবান্বিত ও সম্মানিত করেছে।’ মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সম্মাননা লাভ দেশের মানুষের জন্য আনন্দের। সবাই সমানভাবে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।’
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক যান। সেখানে অধিবেশনের বিভিন্ন সেশনে যোগদান ছাড়াও দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ এবং ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ গ্রহণ করেন তিনি।