মোঃ মোশারফ হোসেন
আল কায়দার দেওয়া হুমকিতে দেশের জনগণ ফের আতঙ্কিত। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারী রবিবার ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজম ভ্যানে আক্রমণ চালিয়ে মৃত্যুদন্ড ও যাবতজীবন সাজা প্রাপ্ত জেএমবির ৩ জঙ্গি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর দেশে জঙ্গি আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ ও প্রচার হলে আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। অবশ্যই ৬ ঘন্টার মধ্যে ছিনিয়ে নেওয়া পলাতক জঙ্গী রাকিবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে বন্ধুক যুদ্ধে রাকিব নিহত হন। তারপর সারা দেশে মানুষের মুখে মুখে ফিরছিল ফিল্মি ষ্টাইলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা।
সূত্র মতে, ২০০৫ সালের পর ফি বছর জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের অনেক সদস্য গ্রেফতার হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৩ সালে কোন জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হয়নি। তবে হুজির ৬ জন, হিজবুত তাহরিরের ২২ জন এবং ভুল বুঝা বুঝির কারণে হিজবুত তাওহীদের ৩ সদস্য গ্রেফতার হলে হিজবুত তাওহীদের ৩ সদস্যকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ১৭আগষ্ট জেএমবি জঙ্গিদের কর্তৃক সিরিজ বোমা হামলার মামলায় ৪৫ জন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী কারাগারে আছে। ২০০৭ সালে ২৯ মার্চ রাতে শীর্ষ ৬ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম(বাংলা ভাই), খালেদ ছাইফুলাহ, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আওয়াল ও ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর হয়। তারপর আর কোন জঙ্গির ফাসি কার্যকর হয়েছে কি’না জানা নেই। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ৩৯ জন আপিল করেছেন, অন্যান্য ১৩৫ জন খালাস ও জামিন পেয়েছেন। খালাস ও জামিন প্রাপ্ত ১৩৫ জন জঙ্গি সদস্যরাই নামে-বেনামে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে ধারনা করা হচ্ছে। কারাগার থেকেই বিভিন্ন ভাবে তাদের অনুসারীদের পরিচালনা করছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের আসামী করে ফেব্র“য়ারী ২০১৩ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ১১৬টি মামলা হয়েছে। অর্ধ শতাধিক বিচারাধীন, ১০২টি রায় হয়েছে। এতে ৪৫ জনের মৃত্যুদন্ড, ১১৮জনের যাবত জীবন, ৯৯জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড, ১১৮ জন খালাস ও ৩৫ জন জামিনে থাকাসহ ৫৭ জন পলাতক রয়েছেন। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি নির্মূলে গঠিত হয়েছে কাউন্টার টেরোজিন ব্যুরো। দেশ থেকে চুড়ান্ত ভাবে জঙ্গি নির্মূল হওয়ার পূবেই চলতি মাসে আল কায়দা সংগঠন বাংলাদেশকে হুমকি প্রদর্শন করে।
সারা দুনিয়ার ত্রাস সৃষ্টিকারী আল কায়দার কর্ণদার ওসামা বিন লাদেনের পক্ষ থেকে হুমকির সূত্র ধরে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড ধ্বংসের মতো অনেক মানবতা বিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘঠিত হতে গণমাধ্যমে দেখেছি। ২০১১ সালে আমেরিকার অভিযানে লাদেন নিহত হলে ধীরে ধীরে লাদেনের স্থান দখল করে আয়মান আল জাওয়াহিরি। তাঁর নির্দেশেই বর্তমানে যাবতীয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে তার অনুসারীরা। আল কায়দা গোষ্ঠির ভিডিও চিত্র মতে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের বেশকটি রাজ্য তাদের টার্গেট। আল কায়দা সশস্ত্র শক্তিশালী দল বলে সবাই জানি। উন্নয়নশীল দেশে গুপ্ত হামলা চালিয়ে নাশকতাসহ শক্তি সঞ্চয় ও দলীয় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করাই তাদের উদ্দেশ্য। সদ্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েটি দেশে আল কায়দা শাখা খোলার ঘোষণা দেওয়ায় ঘোষণায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের মাঝে এক ধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বিশ্বে কয়েকটি দেশে আল কায়দার ভূমিকা সুস্পষ্ট। তাই বলে এনিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর ও কাউকে হয়রানি করা উচিত হবে না। বাঙ্গালীদের বিশ্বাস বিদেশ থেকে বললেই বাংলাদেশে জঙ্গি বাদ কায়েম হবে এমন বলা বা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা আমাদের উচিত হবে না। তবে, যারা জঙ্গিবাদ লালন করে. যারা আল কায়দার এদেশীয় দোসর তাদের খোঁজে বের করতে সরকারের সজাগ দৃষ্টিসহ অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। বাড়তি নিরাপত্তা ও নজরদারী থাকলে আল কায়দার দেওয়া কোন ঘোষণা তেমন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে করেন না সুধীজনরা। সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দেশের অর্থনীতির গড়া গতিকে স্থিমিত করতে জঙ্গিবাদকে ব্যবহারের ষড়যন্ত্র চলছে, এমনটা ভাবাও অযুক্তিক হবে না। বাংলাদেশকে তারা টার্গেট করার একটি কারণ হিসাবে বুঝা যায়- এদেশে আল কায়দার পছন্দের দল ক্ষমতাতে আসতে না পারা। আল কায়দার বর্তমান প্রধান সংগঠক জাওয়াহিরি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে তাদের শাখা স্থাপনের হুমকি দিলে ভারত ইতোমধ্যে সর্তক হয়েছে। বাংলাদেশকেও সর্তক থাকা উচিত। দেশে যারা জঙ্গিবাদ লালন করছে তাদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছে কি’না তা খতিয়ে দেখা দরকার। তারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেশীয় জঙ্গি সংগঠন গুলোকে ব্যবহার করতে পারে। এজন্য বিষয়টিকে সহজে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। রাজনৈতিক অবস্থা ও প্রশাসন দূর্বল হয়ে পড়লে যে কোন দূর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। তাই বলে শুধুমাত্র মাদরাসা শিক্ষকদের তথ্যাবলী নিয়ে তাদের উপর নজরদারী করলেই চলবে না। কেন’না জঙ্গিরা বুঝে গেছে কোন জঙ্গি দূর্ঘটনা ঘটলে প্রথমেই মাদরাসার মৌলভী, শিক্ষক-কর্মচারীদের নজরদারীতে আনা হয়। তাই তারা মাদরাসাকে ব্যবহার না করে যে কোন কিছুর বিনিময়ে অন্য কোন রাস্তা বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে পারে। জঙ্গি-আল কায়দার সদস্যরা বছরে ২/৩ বার লেবাছ পরিবর্তন করতে পারে যার বেশকটি চিত্র গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রকাশ হয়েছে। ভিডিও বার্তা সম্পর্কে মন্তবে অনেকেই বলছেন- বর্তমান সরকারকে আতঙ্কিত করতে ৭১’র রাজাকারের দোসররা বার্তাটি তৈরী করতে পারে এমন চিন্তা ভাবনাটিও বাদ দেওয়ার নয়। আল কায়দার এমন হুমকি আমরা এর আগেও অনেক শুনেছি কিন্তু বর্তমানে চিন্তা হল ‘রাখাল ও বাঘের’ গল্পের মত হতে পারে কি’না। কোন হুমকি বা কোন প্রতিপক্ষকেই ছোট করে দেখে ভুল করা যাবে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ দু’টি নিয়ে বিষয়টি মোকালেবা করতে হবে। তারা যেন, কোন ভাবেই ঘোষণায় সংশ্লিষ্ট দেশে ঘাটি করতে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা অতীব জরুরী।
শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জের জনগণ গণমাধ্যমে আল কায়দার হুমকির কথা শুনে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এথেকে রক্ষা করতে জনসচেতনতা সৃষ্টি সহ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের নিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে জোট গঠন করেছিলেন সে জোটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে আল কায়দার হুমকি ভয় পাওয়ার কিছু দেখিনা । কারণ আমাদের মাথার উপরে যোগ্য প্রধান মন্ত্রীর নেতৃত্বে কর্ম চঞ্চল, দক্ষ, কর্মঠ ও কৌশলী একটি মন্ত্রী পরিষদ রয়েছে। তাঁরা একের পর এক সৃষ্ট সমস্যাকে কেউ বুঝে উঠার আগেই যে ভাবে মোকালেবা করেছেন তা জাতিকে নিশ্চিন্তে রাখার জন্য যথেষ্ঠ। তবে দেশ যখন বন্যার পানিতে হাবু-ডুবু খাচ্ছে ঠিক তখনই মাত্র এক পক্ষ কালের মধ্যে আল কায়দার হুমকি, কারাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুদন্ডাদেশের সাজা প্রাপ্ত মোঃ দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর লেখা ‘নন্দিত জাতি-নিন্দিত গন্তব্যে’ এবং সদ্য সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ,কে,খন্দকারের ইতিহাস বিকৃত ‘১৯৭১ঃ ভিতরে বাইরে’ বই প্রকাশ, কারও কারও বিদেশ ভ্রমণ……….. ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ সবাই জানি -মৃত শামুকেই পা কাটে এবং ময়লাযুক্ত জিনিসে জীবানু থাকে, আবার এটাও শুনেছি, নিজের পকেটের ছুরি পকেট কাটলে কাউকে কিছু বলার থাকে না।
বন্যা বিধস্ত এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অতিদ্রুত ত্রাণ ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা, সারা দেশের কমিটি নবায়ন করাসহ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবন্দ, ইসলামি চিন্তাবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, লেখক-গবেষক, শিক্ষক-সাংবাদিক, র্যাব, পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে আলোচনা করে প্রতিবেশী দেশ ও বন্ধু দেশ গুলোকে নিয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এবং সংগ্রামী জনগণ ও প্রশাসন সচেতন থাকলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ -আল কায়দার কার্যক্রম পরিচালনা করা কোন দিনই সম্ভব হবে না।
লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক