মো: মেরাজ উদ্দিন : চাঁই তৈরী করে ভাগ্যবদলের মডেল এখন শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ৪ গ্রাম। মাছ ধরা চাঁই তৈরী করে এসব গ্রামের মানুষের ভাগ্যের বদল হয়েছে। এ উপজেলার বালিয়াচন্ডী ও দহেরপাড়ের প্রায় ৩শ পরিবারের লোকজন এক সময় খুবই অভাবে দিন কাটাতো। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতো তারা। ক্ষিধের জ্বালায় টাকা ছাড়াই শুধু ভাত খেতে দিলেই তারা কাজ করে দিতো। এ অবস্থায় এ গ্রামের লোকজন আয়ের নতুন পথ খুঁজে পায় মাছ ধরা চাই তৈরী কাজের মাধ্যমে। একটি, দুটি করে এখন সবগুলি পরিবারের সদস্যরা শুরু করছে চাই তৈরীর কাজ। তারা কাজের মাধ্যমেই রুপকথার গল্পের মতো অভাব দূর করে এখন তারা স্বাবলম্বী ও সুখী। তবে হতদরিদ্র এই গ্রামবাসী ডিজিটাল সময়েও বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত। এ যেন তাদের কাছে সোনার হরিণ।
এ গ্রামটির ছাত্র-যুবক, গৃহিনী, বৃদ্ধ সবাই, কেউ বাঁশের শলাকা কাটছে, কেউ গাতনীর কাজ করছে, আবার কেউ চাই এর রূপ দিচ্ছে। ছাত্ররা চাই তৈরী করে টাকা সংগ্রহ করে নিজের লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে বাকী টাকা দিচ্ছে অভিভাবকের কাছে। গৃহিনী তার অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ কাজ করে বাড়তি আয় করছে। আর পুরুষরাতো সবাই ব্যস্ত চাই তৈরীতে। তাই এ গ্রামের মানুষের কারোরই পেছন ফিরে তাকাবার কোন সময় বা সুযোগ নেই। বর্ষার ভরা মৌসুমে প্রতিটি ঘরে ঘরে ধানের গোলার মতো গড়ে তোলা হয়েছে চাঁইয়ের গোলা। এ চাই গ্রামের মানুষের সু-ভাগ্যের চাবিকাঠি। এ গ্রামের মানুষের এখন আর কাজের অভাব নেই। সেউরিয়া, পানাইতা বাড়ী ও দহেরপাড়সহ কয়েকটি গ্রামের হাজারেও অধিক পরিবারের লোকজন চাঁই তৈরীতে ব্যস্ত সমময় কাটাচ্ছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটি চাই তৈরী করতে খরচ হয় ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ টাকা ৩শ টাকায়। এতে তাদের লাভ হয় বেশ ভালো। এতে প্রতিটি ব্যক্তি ৬ মাসেই ৭০ হাজার থেকে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। বছরের ৬ মাস এ কাজ করে আর বাকী ৬ মাস করে কৃষি কাজসহ অন্য কাজ। এতে তাদের আয় হয় দ্বিগুণ। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে ওই গ্রামগুলোর সবাই এখন স্বাবলম্বী। তাদের আর অভাব অনটন নেই, মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই দিনাতিপাত করছেন তারা। একসময় অভাব-অনটন, অর্ধাহার-অনাহার ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী, তারাই আজ সফল মানুষের অনন্য উদাহরণ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁই ব্যবসায়ীরা ওইসকল গ্রামের তৈরী চাঁই ক্রয় করে অন্যত্র বিক্রি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ওই ব্যবসায়ীরাও মাসে কমপক্ষে আয় করছে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। চাঁই ক্রয় বিক্রয় করে এসব চাঁই ব্যবসায়ীরাও এখন স্বাবলম্বী। ওই গ্রামবাসীর মানুষের দাবি তাদের গ্রাম বিদ্যুতায়ণ করা হলে তারা দিনে রাতে কাজ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্বল্পপুজির ওই চাঁই তৈরীর কারিগরদেরকে সরকারী-বেসরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে তাদেরকে আরও গতিশীল, উৎপাদনশীল ও বাড়তি আয়ের মানুষ হিসেবে সমাজে সু-প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
এব্যাপারে দহেরপাড়ের বাসিন্দা ও গোপাল খিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র রুবেল বলে, আমি স্কুলে লেখা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাই তৈরীর কাজ করি। এ কাজ থেকে বছরের ছয় মাসে ৪০ হাজারেরও বেশী টাকা আয় করতে পারি। এ টাকা থেকে লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে বাকি টাকা আমার বাবার হাতে তুলে দিই। এতে আমাদের সংসারের আয় বাড়ছে। ছামিউল হক বলেন, একসময় আমরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপোষ থাকতাম। দিনে এক বেলা খাবার পেলে বাকী দুই বেলা না খেয়েই থাকতাম। গৃহিনী হাজেরা বেগম জানান, আমি আমার ঘরের কাজ সেরে চাঁই তৈরী করি। এতে আমি ও আমার স্বামী মিলে দ্বিগুণ আয় করি। তিনি বলেন আমাদের দাবি একটাই আমাদের পাড়াটা বিদ্যুতায়িত করে দেয়া হোক। মোশারফ, জিয়াউর রহমান, সোহেল রানাসহ গ্রামের আরো অনেকেই বলেন, আমরা এখন আর কারো কাছে হাত পাতিনা। আমরা এখন স্বাবলম্ভী। তবে আমাদের দাবি একটাই বিদ্যুত চাই। এব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ খোরশেদ আলম ফর্সা বলেন, ওই গ্রামে আমরা ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়াও বিদ্যুতায়ন করার জন্য বিদ্যুত বিভাগের সকল দপ্তরে আমরা আবেদন জানিয়েছি।
