পবিত্র ঈদুল ফিতর তো চলেই এলো। ঈদ উপলক্ষে পত্রিকার পৃষ্ঠায় এখন মুদ্রিত হচ্ছে নানা রিপোর্ট। কোনো রিপোর্টে ঈদবাজার পরিস্থিতি, কোনো রিপোর্টে ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনার চিত্র, কোনো রিপোর্টে আবার বলা হচ্ছে, ঈদের পরে উত্তপ্ত হবে রাজনৈতিক ময়দান। নানা রিপোর্টের মেলায় কাঙ্খিত রিপোর্টটি কিন্তু নজরে পড়ছে না। অথচ সেই রিপোর্টটির জন্যই তো রমযানের আগমন, ঈদের আগমন। জানি না কোন্ দিন পত্রিকার পৃষ্ঠায় লেখা হবে- ঈদের আগমনে ঘুচে গেছে মন্দা, মুছে গেছে রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ, আনন্দের মিলনমেলায় জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ, সামনে সমৃদ্ধির অভিযাত্রা। না, এমন কোন বার্তা পত্রিকার পৃষ্ঠায় আজও নেই।
রমযান আসবে, রমযান চলে যাবে অথচ আমাদের জীবনে ঈদ আসবে না- এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। এখন আমরা যে ঈদ পালন করছি তার অবশ্য একটা আনুষ্ঠানিক রূপ আছে – তা অনেকের জন্যই আনন্দঘন এবং বর্ণাঢ্যও বটে। কিন্তু ঈদের মর্মবাণী আমাদের জীবনে, সমাজে কতটা প্রতিষ্ঠিত ? ঈদতো আসে পুরো এক মাসের সিয়াম সাধনার পর। সিয়াম বা রোজা পালনের উপহার ঈদ। তাই ঈদ পালনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সিয়াম-সাধনার তাৎপর্য উপলব্ধি। সিয়াম বা রোজার লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন। আর তাকওয়া অর্জনের অর্থ হলো আল্লাহর বিধি-নিষেধের আলোকে সতর্ক জীবনযাপন। এ জন্যই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রোজা রেখেও যে মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ বর্জন করলো না তার উপবাসে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। এই বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, শুধু উপবাসের নাম রোজা নয়। আমাদের জীবনে, আমাদের সমাজে আজ যত দুঃখ-কষ্ট ও গ্লানি তার মূলেই রয়েছে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে গাফিলতি এবং মিথ্যা কথা ও কাজ। এই দৈন্য ও ভ্রান্তি দূর করার জন্যই তো রমযানের আগমন। আর দুঃখের এসব কারণ দূর হবে বলেই তো ঈদ। কিন্তু রমযান আসার পরও ঐসব ভ্রান্তি ও দৈন্য যদি আমাদের জীবন থেকে দূর না হয় তাহলে ঈদের প্রকৃত আনন্দ আমরা অর্জন করবো কিভাবে ? এখানে হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি বক্তব্য আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘‘মুসলমানের ঈদ প্রতিদিন। প্রতিদিনই তারা গুনাহ থেকে দূরে থেকে সওয়াব ও মুক্তির খুশি লাভ করে।’’ এই বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, ঈদ শুধু পহেলা শাওয়াল তারিখেই সীমাবদ্ধ নয়। গুনাহ থেকে দূরে থেকে প্রতিটি দিনকেই আমরা ঈদের আনন্দে সমৃদ্ধ করতে পারি। এখন প্রশ্ন হলো, গুনাহর কাজগুলো কি? নামাজ-রোজা না করলেই কি শুধু গুনাহ হয় ? নাকি মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করলে, মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচার করলেও গুনাহ হয় ? আসলে গুনাহ হয় আল্লাহর হক এবং বান্দার হক নষ্ট করলে। এক কথায় ইসলামী জীবন দর্শনের আলোকে যে কোন অন্যায় ও অসঙ্গত কাজই গুনাহর কাজ। তাই গুনাহর প্রসঙ্গে চলে আসে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, এমনকি রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গও। যেখানেই অন্যায় ও জুলুম সেখানেই গুনাহ।
আমরা তো চাই ঈদের আনন্দটা বছরের অন্য সময়ও যেন উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু তেমন কোনো আয়োজন আমাদের আছে কী ? আনন্দ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঈদের মর্মবাণীকে আমরা এখনও ধারণ করতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে বছর দুই আগের সংবাদপত্র থেকে ছোট্ট একটা শিরোনাম উল্লেখ করলেই আমাদের সমাজ জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করা যাবে। শিরোনামটি হলো, ‘হকাররা ঈদ বকশিশ দিচ্ছে সোয়াশ’ কোটি টাকা।’ খবরটিতে বলা হয়েছিল, পবিত্র রমযান মাসের আগের থেকে ঈদ পর্যন্ত মাসাধিককালে রাজধানীর ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয়েছে প্রায় একশ’ পঁচিশ কোটি টাকা। রাজধানীর ফুটপাতের দেড় লাখ হকারের কাছ থেকে এই চাঁদা আদায় করা হয়েছে। হকারদের কাছ থেকে আদায় করা চাঁদার টাকা ভাগ হয়ে চলে গেছে বিভিন্ন পকেটে। রমযান শুরু হওয়ার পর থেকে রাজধানীর ফুটপাত তো হকারদের দখলে গেছেই, এমনকি যানবাহনের চলাচলের রাস্তাও হকাররা দখল করে পসরা বসিয়ে ব্যবসা করেছে। বিষয়টি যে বেআইনি একথা আমরা সবাই জানি। এজন্যই এখানে আইনের কথা বলে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা গ্রহণ করেছে আবার আইনের লোকেরাই। এসব চাঁদা আদায়ের জন্য থাকে পুলিশের নিয়োগকৃত লাইনম্যান। লাইনম্যানের সাথে চাঁদা আদায়ে সহযোগিতা করে থাকে পুলিশের সোর্স। প্রতিদিনই রাজধানীর ফুটপাতের দেড় লক্ষাধিক হকারের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মত চাঁদা আদায় করা হয়েছে। চাঁদার টাকার একটা বিরাট অংশ চলে গেছে পুলিশ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের পকেটে, স্থানীয় প্রভাবশালী সরকারি দলের নেতাদের পকেটে। চাঁদার টাকা গেছে লাইনম্যান, পুলিশ সোর্স, স্থানীয় সন্ত্রাসী, সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ ও সাদা পোশাকের দুর্নীতিবাজ আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যদের পকেটে। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ফুটপাতের হকারদের পুনর্বাসনের নামে অনেক রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু তাতে আসল কাজটি হয়নি। হকারদের পুনর্বাসনের নামে অনেক হকার নেতা এখন কোটিপতি বনে গেছেন। রেলওয়ে, সিটি কর্পোরেশন, বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারের খাস জমি নিয়ে হকারদের নামে অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ করে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু দুর্নীতিযুক্ত তালিকার কারণে প্রকৃত হকাররা পুনর্বাসনের সুযোগ পায়নি। ফলে আজও নুন আনতে পানতা ফুরায় তাদের। এদিকে হকার নেতা ও হকার নামধারী প্রভাবশালীরা বহুতল ভবনে দোকান নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে নির্বিবাদে। ফলে ফুটপাতের হকাররা এখনও রয়ে গেছে ফুটপাতে। আর মাঝে মাঝে আমরা হকার উচ্ছেদের নামে যে পুলিশী অভিযান দেখি তাও লোক দেখানো। চাঁদা ও ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়ে গেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফুটপাত আবার চলে যায় হকারদের দখলে। দরিদ্র হকারদের নিয়ে রাজনীতিবিদ, পুলিশ প্রশাসন ও হকার নেতাদের যে আচরণ আমরা লক্ষ্য করছি সেখানে ন্যায় ও আইনের শাসনের কোন উদাহরণ নেই। অথচ হকারদের পসরা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও হকার নেতাদের যে তৎপরতা তাতো ঈদকে কেন্দ্র করেই। ঈদ উৎসবের জন্য অর্থের প্রয়োজন। আর এই অর্থ সংগ্রহের জন্য চলে চাঁদাবাজিসহ বেআইনি নানা কাজ। এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ে বেকার যুবক, প্রশাসনের লোক এবং রাজনীতিবিদরা। যে সমাজে এমন আচরণ অব্যাহত থাকে সে সমাজে ঈদের প্রকৃত আনন্দ আসবে কেমন করে? হকারদের ছোট্ট খবরটি বিশ্লেষণ করলে আমাদের প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজ চিত্রের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
রমযানের শিক্ষা থেকে শুধু ব্যক্তি মানুষ নয়, উপকৃত হতে পারতো আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাও। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা রমযানের আনুষ্ঠানিকতাকে গ্রহণ করলেও তার মর্মবাণীকে সেভাবে গ্রহণ করছি না। ফলে স্ববিরোধীতায় ভরপুর হয়ে উঠেছে আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতিসহ আরো বহুকিছু।
রমযানের মর্মবাণী গ্রহণ করলে তো আমাদের রাজনীতিতে কথা ও কাজে গড়মিলের দৃশ্যটা এমন প্রকট হয়ে উঠতো না। বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
লেখক : সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা।
