‘গ্লেডিয়েটর’ শব্দটি মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাহস, ধৈয্য আর শৌর্য-বীর্যের প্রতিকৃতি। প্রাচীন রোমের সেইসব যোদ্ধাদের বলা হতো গ্লেডিয়েটর যারা মানুষ এবং হিংস্্র পশুর সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হতো। একটা সময় ছিল যখন পেশীশক্তিতে বলীয়ানদেরই ছিল জয়জয়কার। কালের পরিক্রমায় একসময় পেশীশক্তির স্থান দখন করে নেয় ‘অর্থ’। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আর্থিকভাবে শক্তিশালীরাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানের আবিস্কার আর প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ‘পেশী’ আর ‘অথর্’কে টেক্কা দিয়ে ‘ইনফরমেশন’ বা তথ্য হয়ে ওঠেছে শক্তির আধার। হাল সময়ে বলা হচ্ছে-যার কাছে তথ্য বেশী সে ততবেশী শক্তিশালী।
মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট দূরকে করেছে নিকটবর্তী। ঘরে বসেই মানুষ পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ের খোঁজ নিতে পারছে। একজন মুহুর্তে জেনে নিতে পারছে কোথায় কখন কি হচ্ছে, কি ঘটছে। তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ পুরো পৃথিবীকে ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত করেছে। ফেসবুক, টুইটার, ব্লগের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথ্য আদান-প্রদান, বিনোদন, শিক্ষা ও জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হয়ে ওঠেছে। এর পাশপাশি রয়েছে নানা ধরনের ওয়েব পোর্টাল, নিউজ পোর্টাল এবং ওয়েবসাইট। এসবই ‘অনলাইন মিডিয়া’ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ আবার একে ‘নিউ মিডিয়া’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। অনলাইন মিডিয়া বা নিউ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ একজন মানুষ নিজেকে আপডেট রাখতে পারছেন। ক্লিকের পর ক্লিকের মাধ্যমে খুলে যাচ্ছে তথ্যের অবাধ জানালা।
অনলাইন মিডিয়ার শক্তি এবং প্রভাব কি রকম হতে পারে তা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই দেখতে পারি। মধ্যপ্রাচ্যের ‘আরব বসন্ত’ অনলাইন মিডিয়ার ফসল। তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়ায় দীর্ঘদিনের একনায়ক শাসকদের পতন অনলাইন মিডিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সংগঠিক হয়। আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের দাবীতে যে গণজাগরন মঞ্চ আজ সোচ্চার সেটাও অনলাইন মিডিয়ার অবদান। অনলাইন অ্যাকটিভিষ্টরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে একাত্তুরের কসাই খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুদন্ডের দাবীতে মুহূর্তে শাহবাগকে ‘প্রজন্ম চত্বর’ আখ্যা দিয়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। একজনমাত্র ব্যাক্তি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। যিনি তার উইকিলিকসে‘র মাধ্যমে সারাবিশ্বের মোড়ল, সুপারপাওয়ার, একচ্ছত্র অধিপতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছেন। এতে মার্কিনীদের মুখোশ উন্মোচন হওয়ায় তারা বেকায়দায় পড়েছে।
অনলাইন মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভুমিকায় যেমন ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়, ঠিক তেমনই এর দায়িত্বহীন ব্যবহারে সমাজে নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে পারে। হতে পারে বিশৃ্খংলা, ধ্বংসযজ্ঞ। কিছুদিন আগে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ও পল্লীতে হামলা-লুট, অগ্নিসংযোগ এবং যুদ্ধাপরাধির মামলায় জামায়াত নেতা সাঈদীকে চাঁদে পাঠিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় সেটা ওই দায়িত্বহীনতার কারণেই। কাবা শরিফের গেলাফ পরিবর্তনের ছবিকে সাঈদীর ফাঁসির প্রতিবাদে মানববন্ধনের ছবি বলে ধর্মপ্রাণ মানুষদের সহানুভতি পেতে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে। সমাজে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার ইন্ধন হয়েছে।
অনলাইন মিডিয়ার এই সময়ে অনলাইন পত্রিকার ছড়াছড়ি। যে যেমনভাবে পারছেন নিজেকে সম্পাদক-সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত করার কোশেষ করে যাচ্ছেন। কেবলমাত্র একটি ওয়েবসাইট চালু করেই যেনতেনভাবে অনলাইন পত্রিকা বলে প্রচার করছেন। অনেকক্ষেত্রেই সংবাদপত্র-সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাকেও মানা হচ্ছেনা। সংবাদ-বিনোদন, মতামতও আপডেট থাকছেনা। ‘ডাউনলোড কপি আর পেষ্ট’ সর্বস্ব হয়ে পড়ছে এসব অনলাইন পত্রিকা। নিজেরাই যেখানে ক্রিয়েটিভিটির স্ফুরণ দেখাতে পারছেনা, সেখানে সমাজ, দেশ, জাতিকে এসব অনলাইন পত্রিকা কিসের বার্তা দিতে চায় তা আমার মতো সাধারন মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠছেনা। অবশ্য দেশে এখনও অনলাইন পত্রিকার নীতিমালা না হওয়ার সুযোগটিকেই সবাই কাজে লাগাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ আর কিছু ক্ষেত্রে নানাভাবে সুবিধা নেওয়া এবং নিজেকে প্রকাশ করাই এসব অনলাইন সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমার মতের সাথে কারো মতের মিলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে ‘গায়ে না মানলেও আপনি মোড়ল’ হতে বাঁধাতো নেই! অনলাইন সংবাদপত্রগুলো দায়িত্বশীলতার সাথে সামাজিক পরিবর্তনে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে- এমন প্রত্যাশা রাখতে হতাশ হতে চাই না। নিয়ত: স্বপ্ন দেখি পরিবর্তনের। কাঙ্খিত পরিবর্তন একদিন হবেই, এমন আশায় বসতি এই যাপিত জীবনে।
লেখক : হাকিম বাবুল, সাংবাদিক ও সংগঠক, E-mail : hakimbabul@gmail.com