মাছ শিকারের টোপে কদর, প্রয়োজন চাষ পদ্ধতির উদ্যোগ
উন্নয়ন-অগ্রগতির ডামাডোলে শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড় পর্যটন এলাকার খ্যাতি পেলেও আজও বাড়েনি ওই এলাকার দরিদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙালি মানুষের কর্মসংস্থান। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়নি তাদের জীবনমানের। তাই নিজেদের বেকারত্ব, অভাব মোচন আর জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন পথ। এর মধ্যে পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, কৃষি কাজের শ্রমিক, বালু শ্রমিক ও রাখালের মতো পেশা বেছে নিয়ে কোনরকমে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন পার করছেন অনেকেই। ওই অবস্থায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙালির একটি অংশ পাহাড়ের গাছগাছালি থেকে ডোল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে জীবিকার পথ বেছে নিয়েছেন। বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২ শতাধিক মানুষ এ পেশার সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। তারা সংগ্রহ করা পিঁপড়ার ডিম সীমান্তের একাধিক এলাকায় বসে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। আর পাইকাররা ওই ডিম কিনে উপজেলা, জেলা শহর ও পার্শ্ববর্তী জেলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাছ শিকারের সরঞ্জামাদির দোকানে সরবরাহ করছেন। ফলে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহও এখন পাহাড়ি জনপদে জীবিকায়নের পথ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

শেরপুর সীমান্তের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিস্তৃত অঞ্চল গারো পাহাড় অধ্যুষিত। ওইসব এলাকার বনাঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক শাল-গজারি আর সামাজিক বনায়নের একাশি গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। বর্ষা মৌসুমে ওইসব গাছপালার মগডালে, পাতায় ও খোড়লে বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে থাকে এক শ্রেণির লাল বড় পিঁপড়া বা ডোল পিঁপড়া। পাহাড়ি ওই পিঁপড়া প্রথমে গাছের মগডালে তাদের মুখের এক জাতীয় আঠার মতো লালা দিয়ে দুটি পাতাকে এক করে ঠোঙার আকৃতি তৈরি করে। পরে সেখানে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। এ জাতীয় পিঁপড়া মাটিতেও অনেক সময় ডিম পাড়ে। তবে গাছের পাতার মধ্যে ডিম পাড়তে বেশি নিরাপদ মনে করে তারা। আর ওই ডিম সংগ্রহে কাজ করে পাহাড়ি দরিদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙালির একটি অংশ। তারা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পাহাড়ি শাল-গজাড়ি বনে এবং আম, জাম, লিচুগাছসহ বিভিন্ন গাছ থেকে বাঁশের আগায় নেট বা জাল দিয়ে এক ধরনের ঠোঙা তৈরি করে ওই ডিম সংগ্রহ করেন। এভাবে সারা দিন ঘুরে ঘুরে একেকজন ৫০০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ এক কেজি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে পারেন। পরে তারা ওই পিঁপড়ার ডিম রাংটিয়া ও বাকাকুড়া হাটে নিয়ে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। এজন্য সীমান্তের রাংটিয়া ও বাকাকুড়া পিঁপড়ার হাট হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। এ হাটে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে পিঁপড়ার ডিম বিক্রি। এখানে জেলার সীমান্তবর্তী ৩ উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এবং জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জের গারো পাহাড়ের শাল-গজারি বন এলাকা থেকে আসেন ডিম সংগ্রহকারীরা। আর পাইকাররা ওই পিঁপড়ার ডিম কিনে শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ ঢাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন। আর ওইসব দোকান থেকে সৌখিন মৎস্যশিকারিরা চড়ামূল্যে সংগ্রহ করেন সেই ডিম। ওই ডিম বড়শিতে মাছ শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহার হয় এবং টোপে পিঁপড়ার ডিমের মিশ্রণের কদরই আলাদা। তবে সারা বছর পাওয়া যায় না পিঁপড়ার ডিম। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ডিম বেশি পাওয়া গেলেও ডিমের চাহিদা থাকে আশ্বিন-কার্তিক মাসের দিকে। অবশ্য তখন পাহাড়ে ডিম কম পাওয়া যায়।
সরেজমিনে সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার প্রত্যন্ত রাংটিয়া এলাকায় গেলে কথা হয় ডিম সংগ্রহকারী টেমাল সাংমাসহ কয়েকজনের সাথে। ওইসময় টেমাল সাংমা বলেন, আমরা পাহাড়ের অবহেলিত মানুষ। পাহাড়ি এলাকায় সৌখিন মানুষের যাতায়াতের কথা চিন্তা করে অনেক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলেও আমাদের জীবনমানের কোন পরিবর্তন হয় নাই। কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থাও নাই। ফলে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ভিন্ন কিছু পেশার মতো পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহকেই আমরা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। পাহাড়ের গাছগাছালি থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিঁপড়া সংগ্রহ করে আমরা সংসার চালাচ্ছি। বাকাকুড়া গ্রামের ডিম সংগ্রহকারী আদিবাসী ডেনিয়েল সাংমা জানান, আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পাহাড়-জঙ্গল ঘুরে ডিম সংগ্রহ করি। মোটামুটি ৪শ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারি। প্রতি কেজি এক হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এতে আমার সংসার চলে। একই গ্রামের জামাল মিয়া জানান, গাছ থেকে এ ডিম পাড়তে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এছাড়া সাপ-বিচ্ছু, মৌমাছি আর হাতির ভয় থাকে। তবুও টাকার জন্য এ কাজ করি।

আরেক ডিম সংগ্রহকারী নিরঞ্জন বলেন, পিঁপড়ার একেকটি বড় বাসা থেকে একশ থেকে দেড়শ গ্রাম ডিম পাওয়া যায়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে দিকে এই ডিমের চাহিদা থাকে বেশি। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে গড়ে দৈনিক ৫শ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করা যায়। আর প্রতি কেজি ডিম এক হাজার থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি করা যায়। যখন মাছ শিকারের মৌসুম থাকে, তখন পিঁপড়ার ডিমের চাহিদাও বেশি থাকে। তবে সব থেকে বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষ দিকে। কিন্তু সেই সময় ডিমের চাহিদা তেমন একটা থাকে না। বিজয় সাংমা (১৮) জানান, বছরের এই সময়ে পাহাড়ে কোন কাজ না থাকায় বেকার আদিবাসী-বাঙালিরা এ ডিম সংগ্রহ করে থাকে। তবে এ ডিম সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট হয়। সেই সাথে হাতি, সাপ ও মৌমাছির আক্রমণের ঝুঁকিও থাকে।
রাংটিয়া গ্রামের পিঁপড়ার ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ী অবিনাশ কোচ জানান, পাহাড়ে এখন কোন কাজ নাই। তাই এই পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসী বাঙালি প্রায় দুই শতাধিক অভাবি মানুষ এ পেশার সাথে জড়িত। কারণ, প্রায় সকলেরই বিভিন্ন সমিতির ঋণের কিস্তি দিতে হয়। বাকাকুড়া এলাকার পিঁপড়ার ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ী আবু সিদ্দিক বলেন, বাকাকুড়া, রাংটিয়া, গজনী, নকশির কয়েকজনের কাছে পিঁপড়ার ডিম পাইকারী মূল্যে কিনে রাখেন। পরে মাছ শিকারী ও শেরপুরের বিভিন্ন দোকানেও পাইকারিতে বিক্রি করেন। অন্য ব্যবসার পাশাপাশি এ ব্যবসা থেকেও আয় হয়ে থাকে। তিনি চাহিদা অনুযায়ী দিনে ৫ থেকে ১০ কেজি ডিম বিক্রি করতে পারেন।
শেরপুরের সৌখিন মাছ শিকারি গোলাম মোস্তফা জানান, পিঁপড়ার ডিম টোপ হিসেবে ব্যবহার করলে বেশি মাছ পাওয়া যায়। পিঁপড়ার ডিম মাছের খুব পছন্দের খাবার। তাই টোপ হিসেবে অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি পিঁপড়ার ডিমও কিনতে হয়।
ঝিনাইগাতীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নেত্রী রবেতা ম্রং জানান, যুগ যুগ ধরে মানুষ জীবিকার তাগিদে নানা রকমের পেশায় যুক্ত হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গারো পাহাড়ের অবহেলিত জনগোষ্ঠির একটি অংশ এখন পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহকেই তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার মতে, সরকারের তরফ থেকে এই পিঁপড়ার ডিম চাষ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেওয়া মানুষকে আর ঝুঁকি নিয়ে বন-জঙ্গল থেকে ডিম সংগ্রহ করতে হবে না। ঘরে বসেই তারা পিঁপড়ার ডিম উৎপাদন ও সরবরাহ করে স্বাবলম্বীতার সুযোগ পাবে।
একই কথা জানিয়ে নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ, শেরপুরের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সীমান্তের জীবন-জীবিকার কথা ভেবে পিঁপড়ার চাষ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির পাশাপাশি বাঙালি বেকার যুবকদের পুনর্বাসনের পথও সুগম হবে।
