জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপাখি ও বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব, এদের আবাসস্থল রক্ষা এবং শিকার রোধে জনসচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’। ‘অরণ্যেই মুক্তি মুক্তডানার’ শ্লোগানকে উপজীব্য করে ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। এরই মাঝে এ সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী সাড়া ফেলতে সমর্থ হয়েছে। সাংগঠনিক কাজের সঠিক তদারকি, গতি আনয়ন ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে জেলার প্রতিটি উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে শাখা সংগঠন গঠন করেছে ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’।

কয়েক বছর আগেও শেরপুর জেলায় বন্যপাখি শিকার, বিক্রি ও পাচার খুব সাধারণ ব্যাপার হলেও বর্তমানের দৃশ্যপট বেশ ভিন্ন। পূর্বে বছরের বিভিন্ন সময় বিশেষ করে শরতের শেষ ভাগ থেকে শীতকাল পর্যন্ত আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির অবাধ শিকার ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক একটি বিষয়। কিন্তু বর্তমানে শিকার বন্ধে জনসচেতনতা তৈরী করে যাচ্ছে সংগঠনটি। সাংগঠনিক উদ্যোগের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগকে এ বিষয়ে নিয়মিত তথ্য প্রদান করে যাচ্ছে ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’। ফলে পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শুধু তাই নয় সংগঠনটি গত ৭ বছরে জেলার বিভিন্নস্থান থেকে ফাঁদ, জাল ও শিকারি কর্তৃক আটককৃত সহস্রাধিক পাখি ও বন্যপ্রাণী উদ্ধার এবং প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছে।
শিকার রোধ বা বন্য পাখি ও প্রাণী উদ্ধার এবং অবমুক্তকরণের পাশাপাশি এদের আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র রক্ষাও এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন যাবত গারো পাহাড়কে বন্যপাখি ও প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণার জোর দাবি জানিয়ে আসছে সংগঠনটি। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক ও বন বিভাগকে একাধিকবার স্মারকলিপি প্রদান করেছে। ফলশ্রুতিতে, বন্যপাখি ও প্রাণীর বেশ কয়েকটি আবাসস্থল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। শেরপুরের জলচর পাখির আবাসস্থল – বিভিন্ন বিল,নদী ও জলাশয় রক্ষাও সংগঠনের অন্যতম দাবি।

সংগঠনের সভাপতি সুজয় মালাকার বলেন, ‘আমাদের পাখি’ শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির অনিয়মিত নিউজ লেটার। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ব্যতীত সারাদেশে শুধুমাত্র শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটিই শুধু পাখিভিত্তিক নিউজ লেটার প্রকাশ করে থাকে। বন্যপাখির সার্বিক অবস্থা তুলে ধরাই এই নিউজলেটারের মূল উদ্দেশ্য। দেশের প্রখ্যাত পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক বিভিন্ন লেখা এই নিউজলেটারে প্রকাশিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এই নিউজলেটারটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সমষ্টিগত বৈজ্ঞানিক তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করবে।
বন্য প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের পাশাপাশি পাখি পর্যবেক্ষণ ও এদের তালিকা তৈরি এই সংগঠনের সদস্যদের একটি নিয়মিত কাজ। সংগঠনের সদস্যরা ইতোমধ্যেই শুধু শেরপুর জেলায় ৩৫৪ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করেছেন। এর মাঝে বেশ কয়েকটি পাখি রয়েছে যা বাংলাদেশের জন্যেই নতুন। অর্থাৎ এই পাখিগুলো শুধু শেরপুর ছাড়া দেশের আর কোথাও দেখা বা এর ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। এদের মাঝে বনচ্যাগা, মুরগীচ্যাগা, কণ্ঠিকুটি শাহিন, লালবুুক ফুলঝুরি, ইউরেশীয় পাহাড়ি নাকুটি, ঊষর কালিকান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিলুপ্তির হাত থেকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জেলায় প্রাপ্ত ৩৫৪ প্রজাতির পাখির আঞ্চলিক ও জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন পাখির নাম সংগ্রহ করা হয়েছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শহীদুজ্জামান বলেন, বন্য পাখি ও প্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা ও খাদ্যের অপ্রতুলতা রোধে প্রতি বছরই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’র সদস্যরা। ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক বৃক্ষরোপণ সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে।
বন্য প্রাণীর শিকার রোধ ও আবাসস্থল সংরক্ষণে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক অঞ্চলে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণও এউ সংগঠনের নিয়মিত কার্যক্রমের একটি অংশ। বন্যপাখি সংরক্ষণ ও জনসচেতনতা তৈরিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত পাখিমেলায় ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’কে ‘Special recognition for Bird Conservation and Awarness’ পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রাপ্ত জেলা ভিত্তিক বিশেষ সম্মাননা এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান অর্জন।
