শীতের দিনে শরীর গরম রাখতে মানুষ সাধারণত গরম কিছুই খেতে চায়। ভোজনরসিকরা এ সময়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় খাবার হলো হাঁসের মাংস। এই হাঁস সারা বছর পাওয়া গেলেও বেশি খাওয়া হয় শীতে। শীতে কেন খাওয়া হয়, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেক মতামত রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন শীতকালে হাঁসের গায়ে চর্বি জমে। চামড়ার নিচে জমা চর্বি হাঁসের মাংসের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। কিন্তু অন্য সময়ের হাঁসগুলোতে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না।
আবার অনেকে বলে থাকেন হাঁস হচ্ছে ভীষণ গুরুপাক খাবার। গরমের সময়ে বা ভ্যাপসা গরমে বৃষ্টির সময়ে হাঁসের মাংস খেলে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু শীতকালে হাঁস খেলে গরম লাগবে না, বরং শীত একটু কম লাগবে। শীতকালে শহরের আনাচে-কানাচে ভ্যান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেলে চলে হাঁস উৎসব। সেই সঙ্গে চলে চালের আটার রুটি, কলাই রুটি, চিতই পিঠা কিংবা খিচুড়ি। গ্রামবাংলায়ও প্রচলন রয়েছে হাঁসের মাংস খাওয়ার। সাধারণত বাজারে দুই ধরনের হাঁস দেখা যায়। একটা হলো বাণিজ্যিক খামারে চাষ করা, যাকে বলা হয় চাষের হাঁস। অন্যটি গ্রামের বাড়িতে স্থানীয় খাবার খেয়ে বড় হওয়া দেশি হাঁস।
হাঁসের মাংসের পুষ্টিগুণ
হাঁসের মাংসে প্রোটিন, ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পাশাপাশি সেলেনিয়াম, আয়রন, নিয়াসিনসহ আরো অনেক খনিজ পদার্থ থাকে। চামড়াসহ হাঁসের মাংসে অধিক মাত্রায় ফ্যাট ও কোলেস্টেরল থাকে। গরুর মাংসের চেয়ে হাঁসের মাংসে চর্বির পরিমাণ বেশি। এই চর্বির মধ্যে সম্পৃক্ত চর্বির পাশাপাশি অসম্পৃক্ত চর্বিও আছে। সম্পৃক্ত চর্বিতে আছে কোলেস্টেরল। খনিজ উপাদানের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, জিংক, কপার, ম্যাগনেশিয়াম ও সেলেনিয়াম। হাঁসের মাংসে ফ্যাটি অ্যাসিডও থাকে যথেষ্ট পরিমাণে। তাই হাঁসের মাংস নিয়মিত খেলে স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই এই ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণেই গরম লাগে। হাঁসের মাংসে উচ্চ খনিজ পদার্থ থাকায় গলাব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
হাঁসের ডিমেরও রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। হাঁসের মাংসে মাংসপেশির কর্মক্ষমতা ঠিক রাখে, রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে, ত্বক ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে সাহায্য করে, দেহে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে। আর হাসেঁর ডিমও শরীর গরম করে। এ ছাড়া এ ডিমের রয়েছে নানা উপকার।
হাঁসের চর্বি লিনোলিক অ্যাসিডের একটি দারুণ উৎস, তবে এতে ক্যালরি আর সম্পৃক্ত চর্বি দুটোই বেশি। একসঙ্গে বেশি হাঁসের মাংস খেলে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। হাঁসের মাংস যেহেতু সম্পৃক্ত চর্বিসমৃদ্ধ খাবার, তাই এটি কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তুলতে পারে। যে কারণে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
অতএব হাঁসের মাংস বা চর্বি পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। রান্নার জন্য হাঁসের চর্বি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর উচ্চ ক্যালরির কথা মনে রাখতে হবে। এক টেবিল চামচ হাঁসের চর্বিতে থাকে ১১৩ কিলোক্যালরি। তাই অতিরিক্ত হাঁসের মাংস বা চর্বিযুক্ত হাঁসের মাংস খেলে ওজন বাড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে, তাদের হাঁসের মাংস না খাওয়াই ভালো। আর খেলেও অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিৎ। কারণ এতে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
হাঁসের মাংস রান্নার রেসিপি
শীতের দিনে হাঁসের মাংস রান্নার দুটি রেসিপি জেনে নিন। মাষকলাইয়ের রুটি, চালের আটার রুটি বা সাদা ভাতের সঙ্গে খেতে পারেন এই হাঁসের মাংস।
উপকরণ
হাঁসের মাংস ১ কেজি, সয়াবিন তেল ১ কাপ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, আদাবাটা ২ টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, হলুদ, ধনে, জিরা, গরম-মসলা আর গোলমরিচের গুঁড়ো ১ চা-চামচ করে, মরিচের গুঁড়ো ২ চা-চামচ বা স্বাদমতো, দারুচিনি ২ টুকরো, এলাচি ৪-৫টি, তেজপাতা ৩-৪টি, লবঙ্গ ৩-৪টি।
প্রণালি
প্রথমে হাঁসের মাংস ভালোভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রাখুন। তারপর একটি পাত্রে তেল দিয়ে হালকা গরম করে তাতে পেঁয়াজকুচি, দারুচিনি, এলাচি, তেজপাতা ও লবঙ্গ দিয়ে নাড়তে হবে। পেঁয়াজ হালকা বাদামি হলে তাতে গরম-মসলা বাদে বাটা মসলা ও গুঁড়ো মসলাগুলো দিয়ে কষিয়ে নিন। মসলা কষানো হয়ে গেলে তাতে মাংস দিয়ে দিন। মাংস ঢাকনা দিয়ে সময় নিয়ে ভালোভাবে কষান। প্রয়োজনে সামান্য পানি দিন। হাঁসের মাংস ভালো করে না কষালে গন্ধ থেকে যাবে। যখন মনে হবে কষানোর মধ্যে মাংস হালকা সেদ্ধ হয়ে গেছে, তখন পরিমাণমতো পানি দিন। গরম পানি দেওয়াই ভালো। তারপর মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ হয়ে ঝোল গাঢ় হলে গরম-মসলা দিয়ে নামিয়ে নিন।
আস্ত হাঁসের রোস্ট
উপকরণ
হাঁস ১টি, জিরা ও ধনেগুঁড়ো ১ চা-চামচ, গোলমরিচের গুঁড়ো আধা চা-চামচ, লবণ স্বাদমতো, সয়াসস ১ কাপের ৪ ভাগের ১ ভাগ, তেল ২ কাপ, অ্যারারুট ২ চা-চামচ, মাখন ১ টেবিল চামচ।
প্রণালি
প্রথমে হাঁসটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে গুঁড়ো মসলা, লবণ, সয়াসস দিয়ে মেখে রাখুন। বড় পাতিলে ডুবো পানিতে ঢাকনা দিয়ে হাঁসটিকে ৩-৪ ঘণ্টা সেদ্ধ করে নিন। সেদ্ধ হয়ে এলে ১ কাপ পরিমাণ পানি রেখে হাঁস তুলে নিন। হাঁসের বুকের মাঝখানের বড় হাড়টি টেনে তুলে ফেলুন। এবার গরম তেলে হাঁস হালকা বাদামি করে ভেজে নিন। অল্প একটু পানিতে অ্যারারুট গুলে নিয়ে হাঁস সেদ্ধ করার আগে পানিতে মিলিয়ে জ্বাল দিন। গ্রেভি হলে নামিয়ে ফেলুন। এবার পরিবেশন করুন।