হত্যারহস্য উদঘাটন পুলিশের
শেরপুরের নকলায় গৌড়দ্বার ইউনিয়নের রুণীগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামের দর্জি আইয়ুব আলীকে (৬৩) জমিসংক্রান্ত বিরোধের কারণে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করেছে তারই আপন ভাতিজা মুকুল মিয়া (৪৫), মুকুল মিয়ার বড় ছেলে মহসিন হাসান (২৩) ও আইয়ুব আলীর এক ঘনিষ্ঠ সহচর সেতু রবিদাস (২৩)। সেতু আইয়ুব আলী ও মুকুলের প্রতিবেশি হলেও বেশ কয়েকবছর ধরে সে পিতা রামলাল রবিদাস ওরফে আবুয়া রবিদাসহ পরিবারপরিজন নিয়ে নকলা পৌরসভার বাদাগৈড় মহল্লায় বসবাস করে। আইয়ুব আলীর বাঁধার কারণে মৃত ফুফু নুর জাহান বেগমের জমি ক্রয় করতে না পেরে আইয়ুব আলীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে মুকুল। তার এ কাজে সহযোগিতা করে বড় ছেলে মহসিন ও সেতু। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান।
তিনি জানান, ১৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে খবর পেয়ে গৌড়দ্বার ইউনিয়নের রুণীগাঁও গ্রামের নিজ বাড়ির কাছাকাছি একটি পরিত্য ক্ত ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয় দর্জি আইয়ুব আলীর লাশ। পরে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাবাদের জন্য রাতেই আটক করা হয় আইয়ুব আলীর সহোদর ভাই ছমেদ আলীর ছেলে মুকুল, মুকুলের বড় ছেলে মহসিন ও ছোট ছেলে জিহান হাসানকে (২০)। পরদিন শুক্রবার সকালে সিসি ক্যামেরার একটি ফুটেজের সূত্র ধরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় আইয়ুব আলীর ঘনিষ্ঠ সহচর সেতুকে।
বিষয়টি নিয়ে ১৫ নভেম্বর শুক্রবার আইয়ুব আলীর স্ত্রী রুবি বেগম (৫৫) বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নকলা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যার রহস্য উদঘাটন ও দোষীদের গ্রেফতারে মাঠে নামেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সহকারি পুলিশ সুপার (নালিতাবাড়ী সার্কেল) দিদারুল ইসলাম এবং নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের একটি চৌকস দল। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আটক সেতু নিজেকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মুকুল ও মুকুলের বড় ছেলে মহসিনের নাম বলে দেয়। পরবর্তীতে সেতুর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ১৫ নভেম্বর আইয়ুব আলীর বাড়ির কাছাকাছি একটি ধানক্ষেত থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি দা উদ্ধার করে। পরিত্যক্ত ডোবার পানি সেচে উদ্ধার করা হয় আইয়ুব আলীর ব্যবহৃত দ্’ুটি মোবাইল ফোন ।
১৬ নভেম্বর শনিবার আটক সেতু, মুকুল ও মহসিনকে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের জন্য আবেদন করে পুলিশ। পরে সেতু আদালতে হত্যাকান্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় এবং আদালত রিমান্ড শুনানীর জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করে সবাইকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। অভিযোগ না থাকায় মুকুলের ছোট ছেলে জিহানকে তার মামা কামরুলের জিম্মায় ছেড়ে দেয় পুলিশ।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সেতু জানায়, পুরনো প্রতিবেশি হিসেবে আইয়ুব আলী ও মুকুলের পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিল সেতু। বেশ কিছুদিন আগে সে বিদেশ যাওযার জন্য এক লোককে ৩ লাখ টাকা দেয়। পরবর্তীতে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে না পারায় সেতু অনেক কষ্ট করে ওই লোকের কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়। বাকী ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা সে কোনভাবেই আদায় করতে পারছিল না। এদিকে মুকুল তার চাচা আইয়ুব আলীর বাঁধার কারণে তার বাড়ির পাশে আপন ফুফু মৃত নুরজাহানের রেখে যাওয়া বাড়িভিটার জমি ক্রয় করতে না পারায় আইয়ুব আলীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে মুকুল ও তার বড় ছেলে মহসিন। মুকুল এ কাজে সহযোগিতা চায় সেতুর। বিনিময়ে মুকুল বিদেশ যাওয়ার জন্য সেতুর খোয়া যাওয়া ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা আদায় করে দেওয়ার কথা বলে। আদায় করে দিতে না পারলে প্রয়োজনে সেই পরিমাণ টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়ে দিবে বলে সেতুকে জানায় মুকুল। রাজি হয়ে যায় সেতু। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ নভেম্বর রাতে আইয়ুব আলী নকলা পৌরশহরের ভাড়ার দোকানে দর্জির কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় জরুরি প্রয়োজনে রুণীগাঁও যাওয়ার কথা বলে আইয়ুব আলীর সঙ্গী হয় সেতু।
এদিকে আইয়ুব আলীকে খুন করার উদ্দেশ্যে মুকুল ও তার বড় ছেলে মহসিন একটি নতুন দা কিনে বাড়ির কাছাকাছি একটি কালভার্টের নীচে লুকিয়ে রাখে। আইয়ুব আলী সেতুর সাথে বাড়ি যাওয়ার সময় ওই কালভার্টের কাছে পৌঁছালে দেখা হয় মুকুলের সাথে। তারপর সবাই একসাথে সামনের দিকে এগুতে থাকলে মুকুলের ছেলে মহসিন ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে সেই দা দিয়ে আচমকা কোপ দেয় আইয়ুব আলী মুখে। তারপর সেই দা দিয়ে মুকুল দেয় আরও একটি কোপ। পরে সেতু ও মহসিন রক্তাক্ত আইয়ুব আলীকে মাটিতে শুইয়ে ঝাঁপটে ধরে রাখে এবং মুকুল সেই দা দিয়ে আইয়ুব আলীর গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সবাই মিলে মরদেহ কাছের পরিত্যক্ত ডোবার পানিতে ফেলে রেখে চলে যায়।
মামলার বাদী আইয়ুব আলীর স্ত্রী রুবি বেগম ঘটনার বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তিনি তার স্বামীর হত্যাকারীদের ফাঁসি চান।
এ ব্যাপারে শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মিজানুর রহমান জানান, আসামি মুকুল ও তার ছেলে মহসিনকে রিমান্ডে এনে হত্যাকান্ডের পেছনে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা খুঁজে বের করা হবে। আইয়ুব আলীর পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায় সেজন্য আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য পুলিশ সবকিছু করবে বলে জানান তিনি।