সময়ের ছোবলে হঠাৎ করেই চলে গেলেন মফস্বল বা তৃণমূলের পেশাদার সাংবাদিক রেজাউল করিম বকুল (৫৪)। ১৬ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে শোনা গেলো হার্টের সমস্যায় তাকে শ্রীবরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সাড়ে ১১ টার দিকে তার মোবাইলে ফোন করে কথা হয় তার স্ত্রীর সাথে, তখন এম্বুলেন্সে শেরপুর শহরের কাছাকাছি। এরপর বকুলের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় সাংবাদিক তুহিনের স্ট্যাটাসে বুঝতে পারলাম, তিনিও বকুলকে বহনকারী এম্বুলেন্সে আছেন। ভেবেছিলাম পরে ফোনে ফোনে তার কাছ থেকেই বকুলের আপডেট জানা যাবে। কিন্তু বিধি বাম।
কিছুক্ষণ পরই (রাত ১২.০৮) তার ফোনেই রিং আসে আমার ফোনে। ‘আধার ভাই, বকুল আর নেই, নকলা পার হবার পরই মারা গেছেন।’ এ কথা বলেই তার বাকরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম বুঝতে পেরে সেখান থেকেই শ্রীবরদীর বাড়ির পথে ফেরার পরামর্শ দিয়ে কথা শেষ করি।
না, আর কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে হঠাৎ করেই তার বিয়োগ ব্যথা।
তিনিতো আমার দীর্ঘ দিনে বললে ভুল হবে, প্রায় ত্রিশ ধরে চেনা- জানা এক সহকর্মীই নয়, ছিলেন হৃদয়জুড়ে একজন পরম বন্ধুর মতো আষ্টেপৃষ্টে। ছিলেন আমার শ্যামলবাংলা পরিবারের একজন প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু সদস্য। তাই রাতেই একনজর দেখার জন্য শ্যামলবাংলা পরিবারের নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের রহমান ও বার্তা সম্পাদক জুবাইদুল ইসলামকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাওয়া। শীতের আবহের মধ্যেও দেখা গেলো এ মানুষটিকে একনজর দেখার জন্য আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি সাংবাদিক সহকর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের ভীড়। আমরাও অনুভব করলাম এক স্বজন হারানোর মুহূর্ত।
মানুষের মৃত্যু পৃথিবীর অমোঘ নিয়মেই অনিবার্য। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, আমরা মেনে নিতেই বাধ্য। তবুও বিনা নোটিশের কোনো কোনো মৃত্যু আমাদেরকে বেশি করে কাঁদায়, বেশি করে ও নতুন করে ভাবায়। সহকর্মী বকুলের মৃত্যুও সে রকমই এক উপাখ্যান।
যে বকুল অন্যান্য দিনের মতো সারাদিন তৃণমূলের একজন পেশাদার ও ব্যস্ত সাংবাদিকের মতোই কাটিয়েছেন, যে বকুল মৃত্যুর পনের মিনিট আগেও আমার কথার আওয়াজ শুনেছেন, একঘন্টা পরই তার লাশ দেখতো হবে- এটা কার ভাবনা বা বিশ্বাসে কাজ করে বা করতে পারে?
আমার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় আটত্রিশ বছরের মধ্যে প্রায় আটাশ বছর ধরেই বকুলের সাথে পথ চলা। তার সাথে প্রথম পরিচয় ও সখ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মুহাম্মদ আবু বকর সম্পাদিত সাপ্তাহিক দশকানীয়ার মাধ্যমে। ওই পত্রিকায় আমার দায়িত্বকালীন (স্টাফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) সময় থেকে তাকে পেয়ে এসেছি বিরতিহীন ও নিরবচ্ছিন্নভাবেই। এর পরও বয়স আর অভিজ্ঞতার বদৌলতে দিন দিন বাড়তে থাকে তার কাজের পরিধি। তিনি একসময় দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক মাতৃভূমি পত্রিকায় কাজ করেন। দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন মোহনা টিভি ও দৈনিক কালেরকণ্ঠে। এর পরও দুই হাজার তের সন থেকে আছেন আমার সম্পাদিত শ্যামলবাংলা২৪ ডটকম এ, সিনিয়র বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ছিলেন শ্রীবরদী প্রেসক্লাবের সভাপতি।
চাকচিক্যময়, স্মার্ট দেহের সদা হাস্যোজ্জল মানুষটি প্রায়ই খবরের সন্ধানে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ছুটে বেরিয়েছেন জেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তৃণমূলের সমস্যা, সম্ভাবনা ও উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি দূর্গম জনপথের বিশেষ বিশেষ ফিচার লিখতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। মাঠ পর্যায়ের অনেক লোকজনদের সাথে তার যেমন ছিলো পরিচিতি, তেমনই ছিলো সখ্যতা। এজন্য তিনি তৃণমূলের এক দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
যন্ত্রচালিতের মতো এ ব্যস্ত মানুটি সাংবাদিকতার পাশাপাশি ছিলেন নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত দুনীতি প্রতিরোধ কমিটি ও সুজন এর সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাই স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি, জনপ্রতিনিধি,সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণীপেশার মানুষের কাছে এক অতি পরিচিত মুখ ও মানুষ ছিলেন।
বকুলের মৃত্যুতে আমরা তৃণমূলের একজন দায়িত্বশীল সংবাকর্মী ও সংগঠককে হারালাম। আর তার স্ত্রী- তিন কন্যা হারালো একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক। আমরা হয়তো সেই অভিভাবকের দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারবো না, তবে এলাকার সাংবাদিক সমাজ তার হতাশাগ্রস্ত পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার দায় এড়াতেও পারি না। বিষয়টি যেমন শ্যামলবাংলা পরিবারের একান্ত ভাবনায় থাকবে। আমরা আশা রাখবো হালে গদিসিন সাংবাদিক নেতারাও বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন। একইসাথে আমরা আরও আশা করবো, স্থানীয়ভাবে যেন তাকে স্মরণীয় রাখা যায়- এ ব্যবস্থাটিও স্থানীয়ভাবেই করা উচিত। তখনও আমরা আপনাদের পাশে থাকবো।
লেখক : সম্পাদক-প্রকাশক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক দশকাহনীয়া, সাবেক সভাপতি, শেরপুর প্রেসক্লাব।
(১৭/১১/২৪ খ্রী: ভোর ৫.৩০)