পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ, কমায় ক্যান্সারের ঝুঁকি, বাড়ায় ত্বকের উজ্জলতা
কৃষি, খাদ্য ও শস্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে এবার কাঁকরোল চাষ বেশ সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে সবজি অঞ্চল। এছাড়া উপজেলার গোমড়া গ্রামে বসবাসকারী প্রায় সবাই বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ করেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো কাঁকরোল। তাই গোমড়া গ্রামটি এখন ‘কাঁকরোল গ্রাম’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে।

জানা যায়, ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা গারো পাহাড়ের জেলা শেরপুর। এ জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম গোমড়া। এ গোমড়া গ্রামের ৪শ একর জমিতে প্রায় ৬ শতাধিক কৃষক কাকরোলসহ নানা সবজি চাষ করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাধিক কৃষকই কাঁকরোল চাষের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সবুজে ছেয়ে যাওয়া ওই গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে সবজি গ্রাম বা কাঁকরোল গ্রাম হিসেবে। এ এলাকায় কয়েক বছর আগেও পানি ও বিদ্যুতের অভাবে বহু জমি পতিত ছিল। এখন পানির সুবিধা ও বিদ্যুৎ পাওয়ায় আর পতিত রাখতে হয় না এসব জমি। কৃষি বিভাগের সহায়তা ও পরামর্শে গ্রামের প্রায় সবাই নিজের কিংবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে মৌসুমি সবজি চাষ করছে। এখন পুরো এলাকার সবজির ক্ষেত কাঁকরোলে ছেয়ে গেছে। যদিও এসব ক্ষেতে গরম ও শীতের আগাম সবজি বেশি আবাদ করেন স্থানীয়রা। এখানকার উৎপাদিত সবজির মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে কাঁকরোল কেজিতে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, কাঁকরোলের বীজ কাঁকরোল গাছের নিচে হয়ে থাকে, যা দেখতে মিষ্টি আলুর মতো। মার্চ ও এপ্রিলে এই সবজির চাষ করা হয়। চারা গজানোর ৯০ থেকে ১শ দিনের মধ্যেই এর ফলন পাওয়া সম্ভব। কাঁকরোল লতানো জাতীয় গাছ। স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল একই গাছে হয় না। তাই বাগানে দুই ধরনের গাছ না থাকলে পরাগায়ণ ও ফলন কম হয়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁকরোল অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এতে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, ক্যারোটিন, আমিষ, ভিটামিন এ, বি ও সি এবং খনিজ পদার্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে। কাঁকরোলে ভিটামিন সি থাকায় শরীরের টক্সিন দূর করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। কাঁকরোলে আছে বিটা ক্যারোটিন ও আলফা ক্যারোটিন, যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না, ত্বককে করে উজ্জল। এছাড়া কাঁকরোলের ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে।

সরেজমিনে গেলে কথা হয় গোমড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, আগে এ এলাকায় পানির জন্য প্রায় সব জমিই পতিত থাকত। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ আসায় পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় অনেক জমি আবাদের আওতায় এসেছে। আমরা এখন সবজির মধ্যে কাঁকরোল লাগিয়েছি। আমরা মৌসুমভিত্তিক সবজির আবাদ করে থাকি। সবজি আবাদ করে এলাকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কাঁকরোল চাষে বিঘাতে খরচ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার। যদি ফলন ও দাম ভালো হয় তবে প্রতি বিঘায় খরচ বাদ দিয়ে লাখ টাকার ওপরে লাভ হয়ে থাকে। কৃষক হরমুজ মিয়া বলেন, এটা পাহাড়ি এলাকা। এ এলাকায় আমরা সবজির আবাদই করি। আমি ৫০ শতাংশ জমিতে কাঁকরোল লাগাইছি। আমি এবার কাঁকরোল বিক্রি করে অনেকটা লাভবান। পোলাপানের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। ৫ সদস্যের সংসার চলছে এ আবাদ করেই। কৃষক মালেক মিয়া বলেন, আমরা পাহাড়ের মানুষ ভাই আগে যে কষ্ট করছি। মানুষের জমিতে সারাদিন কাম করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাইছি। কোনো কোনো দিন কামও পাইতাম না। এই টাকা নিয়া বাজার করবার গেলে কষ্ট হইছে। এখন বাড়ির পাশে রহমত ভাইয়ের জমিন বাগি নিয়া শুরু করছি কাঁকরোলের চাষ। এখন আল্লাহর রহমতে নিজেরা ভালা আছি।
তবে কৃষক সফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, এ গ্রামের রাস্তা-ঘাট কাঁচা। যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ থাকায় সবজির ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। কাঁচা রাস্তা হওয়ায় সবজি বাজারে তুলতে কষ্ট হয়। খরচও অনেক বেশি পড়ে যাওয়ায় লাভ কম হয়। সময়মতো বাজারে না নেওয়ায় সঠিক দামও পাই না। আমরা কৃষকরা অবহেলিত। কৃষক আবু বক্কর বলেন, এ এলাকার গ্রামীণ রাস্তাগুলো পাকা করলে আমাদের খুব উপকার হবে। আমরা কৃষকরা সবজি আবাদ করে দামটা বেশি পাইতাম। খারাপ রাস্তায় সব গাড়ি সহজে আসবার চাই না। আসলেও ভাড়া বেশি পইড়া যায়। এজন্য লাভটা কম হয়।
এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হুমায়ুন দিলদার বলেন, সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ইদানিং কাঁকরোলসহ বিভিন্ন সবজির চাষ বেশ সাড়া ফেলেছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে এলাকার অনেকেই এখন পতিত জমিতে কাঁকরোলসহ নানা সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে এ বছর এ উপজেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে কাঁকরোলের আবাদ হয়েছে। কাঁকরোল পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ, ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের ত্বক উজ্জলের কাজে লাগায় দিনদিন এর চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁকরোলের চাহিদা থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। চাষিরা ভালো ফলনের পাশাপাশি মূল্যও পাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কাঁকরোলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ আরও সম্প্রসারিত হলে এ অঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব হতে পারে।
