হামলায় লণ্ডভণ্ড ॥ বন্দীরা মুক্ত থাকায় বাড়ছে অপরাধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারবিরোধী জনরোষের জের ধরে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা-ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে সকল বন্দীর পলায়নের পর লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়া শেরপুর জেলা কারাগার এখনও সম্পূর্ণ অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। হামলা-ভাংচুরের ২ সপ্তাহ পেরিয়েও গেলেও তা সচলে নেওয়া হয়নি তেমন কোন পদক্ষেপ। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের অধিকাংশই মুক্ত থাকার পাশাপাশি নানা অপরাধকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে বাড়ছে অপরাধ। এছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের কার্যক্রম সীমিত আকারে চলমান থাকলেও কারাগার অকার্যকর থাকায় আদালতে নেওয়া হচ্ছে না জামিনঅযোগ্য মামলার আসামিদের আত্মসমর্পণ। একই কারণে পুলিশের সীমিত কার্যক্রম চালু হলেও শুরু হয়নি বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের আটক বা গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান। কারাগারসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্যে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের পরপরই ৫ আগস্ট সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরের দমদমা কালীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত জেলা কারাগারের সামনে জড়ো হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে কারাগার ত্যাগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল কারারক্ষী। ওই অবস্থায় বিক্ষুব্ধ জনতা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ওইসময় তারা কারাগারের প্রধান ফটকটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সকল বন্দীদের বের করে আনে এবং কারাগারে থাকা অস্ত্র, মূল্যবান সামগ্রী, টাকা-পয়সা, আসবাবপত্র, ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলা কারাগার যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের চিহ্ন। কারাগারের প্রধান ফটক, কারারক্ষীদের ব্যারাক, কারাগারের সুপার ও জেলারের অফিস কক্ষ ও বাসভবনের সকল আসবাবপত্র, রান্নাঘর, ক্যান্টিন পুড়ে গেছে। ভাংচুর করা হয়েছে ভেতরের আসামিদের ওয়ার্ড, কনডেম সেল ও কারা হাসপাতালে। ব্যারাকের পুরো কারাগারে লন্ডভন্ড অবস্থা থাকায় বর্তমানে কারাগারের সড়কসংলগ্ন ফটক ও ভেতরের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কারাগারের ভেতরে যাতে কেউ প্রবেশ করতে বা কারাগারের আর কোনো সম্পদ যাতে কেউ বিনষ্ট করতে না পারেন, সে জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা দায়িত্ব পালন করছেন। ভেতরে কয়েকজন কারারক্ষী সাদাপোশাকে ঘুরছেন।

কারা সূত্র জানায়, প্রায় ৮/১০ হাজার মানুষ লাঠিসোটা, রামদা, দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা বন্দীদের ওয়ার্ড ভেঙে ফেলে ও তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেন। বিপুলসংখ্যক মানুষের হামলার মুখে কারারক্ষীরা অসহায় হয়ে পড়েন। ওইসময় কারাগারে আটক ৫১৮ জন বন্দী পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দীদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং ৭০/৮০ জন ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। আর অন্যরা ছিলেন বিচারাধীন ও তদন্তাধীন বিভিন্ন মামলার আসামি। হামলাকারী ব্যক্তিরা কারাগারের ৬১টি অস্ত্রের মধ্যে ৯টি অস্ত্র, চায়নিজ রাইফেলের ৮৬৪টি গুলি, শটগানের ৩৩৬টি গুলি ও কারাবন্দীদের মজুত করা খাদ্যসামগ্রীসহ টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে যান। সেই সঙ্গে কারাগারের মূল্যবান রেকর্ডপত্র, গাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে আসে। তাদের সহায়তায় কয়েকটি অস্ত্র রক্ষা করা সম্ভব হয়। এদিকে জেলা কারাগারের লুণ্ঠিত অস্ত্রসহ মালামাল ফেরত বা অবস্থান জানানোর জন্য স্থানীয় ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর তরফ থেকে মাইকিং করার পর লুণ্ঠিত ৮টি অস্ত্রসহ বেশ কিছু মালামাল জমা দেওয়া হয়েছে।
জেলা কারাগারের সুপার মো. হুমায়ুন কবীর খান বলেন, হাজার হাজার মানুষের সশস্ত্র হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ১০/১২ হাজার জনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়েছে। অন্যদিকে হামলায় লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়া কারাগারের কার্যক্রম চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শেরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম জানান, ধ্বংসস্তুপ থেকে কারাগারকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সময়ের ব্যাপার। তবুও প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হয়েছে। দ্রুতই মেরামতসহ বাকি কাজ শেষ করে কার্যক্রম চালু করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারাগার চালু করা ছাড়া পলাতক আসামিদের আত্মসমর্পণের আহবান জানানো যাচ্ছে না। তবে বিকল্প কোন নির্দেশনা পেলে সেই ব্যবস্থাও করা হবে।
