আন্দোলিত জনপথ, বাড়ছে উৎসুক মানুষের ভিড়
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও গাছ-গাছালির অভাবের পাশাপাশি এক শ্রেণির শিকারীদের কবলে নির্বিচারে নিধনের কারণে বকসহ নানা প্রজাতির পাখি যখন বিলুপ্তপ্রায়, ঠিক তখন শেরপুর সীমান্তের এক পল্লীতে গড়ে উঠেছে পাখিদের অঘোষিত অভয়াশ্রম। ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতিবান্ধা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী কবিরাজপাড়ায় শান্ত পরিবেশে সবুজ গাছ-গাছালি সমৃদ্ধ ছায়াঘেরা এক বাড়িতে অনেকের অদেখাতেই গড়ে উঠেছে ওই অভয়াশ্রম। এলাকায় বাড়িটি একদিকে যেমন পাখিবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, ঠিক তেমনি বাড়িটি জেলা জজ মর্যাদার এক বিচারকের পৈত্রিক নিবাস হওয়ায় তাকে ‘জজের বাড়ি বকের সারি’ বলেও ছন্দে রূপ দিচ্ছেন। ওই পাখিবাড়িতে গাছে গাছে কালো রাঙা ঠোট-পা বিশিষ্ট পাখার পিছনের অংশ সাদাকালো রঙের বকের যেন এক কলোনি। ধবধবে সাদাকালো রঙের বক ছাড়াও ধূসর বক, বড় সাদা বক, মাঝারি সাদা বক, ছোট সাদা বক, ছোট বক ও ময়ুরপক্সক্ষী বকের দেখা মেলে এখানে। সকাল-বিকেল এখানে বকের সারি বেঁধে বসে থাকা বকের আসা-যাওয়ায় বকের কলরবে মুখরিত থাকে বাড়িটি। বছরের পর বছর ধরে ওরা এখানে আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকে। তবে মহামারি করোনার পর থেকে বকের সংখ্যা বেড়েছে।
অন্যদিকে ওই পাখিবাড়ি এখন নজর কাড়ছে এলাকাবাসীসহ আশেপাশের উৎসুক মানুষের। কেবল তাই নয়, প্রায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকেও পাখিপ্রেমী অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন পাখিবাড়িটি দেখতে।

জানা যায়, শেরপুর শহরের খরমপুর মহল্লার জমশেদ ম্যানসনের স্বত্বাধিকারী প্রয়াত জমসেদ আলীর পৈত্রিক নিবাস ঝিনাইগাতীর ওই নিভৃত পল্লী কবিরাজপাড়া। ওই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান খুলনা সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) রোজিনা আক্তার হেলেন। ছুটিতে বা উৎসব-পার্বণে পৈত্রিক নিবাসে এলেই তিনি ছুটে যান কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত কবিরাজপাড়ায়। তারই আগ্রহে বাড়ির লোকজনের সহায়তায় গড়ে উঠেছে সেই পাখিবাড়ি।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ঝোঁপঝাড় ঘেরা বাড়ির এক পাশে দুটি বিশাল শিমুল গাছ। বকেরা অন্যান্য গাছে দৌড়-ঝাঁপ করলেও তাদের আসল বসতি ওই শিমুল গাছকে ঘিরে। গাছ দুটিজুড়ে বসেছে পাখিদের মেলা। পাখিগুলো বেশ আড্ডাবাজ ও শান্ত প্রকৃতির। এ-ডাল ও-ডালে ঝগড়া, খুনসুটি, বাচ্চাদের যত্ন আর পাখিদের ডানার ছপাত ছপাত শব্দে বাড়িটি যেন পাখির দখলে। বিশাল বাড়িজুড়ে থাকে মাত্র ২/৩ জন মানুষ। জজ বাড়িজুড়ে রয়েছে বেশ কয়েটি আধা খনন পুকুর। পুকুর আর বাড়ি সংলগ্ন বিশাল বিলের শামুক ও জলজ প্রাণী খেয়েই ওরা বেঁেচ থাকে। বকেরা ডিম দেওয়ার আগে ওই বাড়িতে থাকা অন্য কোন গাছ বাছাই করে নেয়। তারপর বাসা বানিয়ে ডিম ও বাচ্চা ফুটিয়ে বাচ্চাসহ আবার ওই শিমুল গাছে জায়গা করে নেয়। নিরবতা, গাছ ও পাখির মিতালিতে ওই বাড়ি প্রাঙ্গন ঘিরে সকাল-সন্ধ্যায় পুরো এলাকা আন্দোলিত হয় বকের কলতানে। পাখির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বকগুলো এখন ছড়িয়ে পড়েছে ওই বাড়ির পাশে অন্য কোন নির্জন জায়গায়। চৈত্র মাসে নদী-নালা কিংবা খাল-বিলে পানি আসার সাথে সাথে ওরা চলে আসে ওই বাড়িতে। এরপর প্রায় অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত থাকে ওখানে। এর মধ্যে বর্ষার প্রজনন মৌসুমে বক ছানা জন্ম নেয় ওখানে। শামুকখোল বকগুলো ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আসে, আবার অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে চলে যায়। তবে অন্য বকগুলো থাকে সারা বছর।

জজ বাড়ির ছোট ছেলে ব্যবসায়ী শাহীনুর ইসলাম রেজভি শাহীনও কাটান শহরের বাসায়। আবাদ মৌসুমসহ নানা প্রয়োজনে যাতায়াত করেন পৈত্রিক গ্রামের বাড়িতে। তিনি জানান, আমার বড়বোন কর্মস্থল থেকে পাখিগুলোর খোঁজ রাখেন নিয়মিত। বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বকগুলো নাম শামুক খোল জাতের। বাড়িটির আশেপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে বিল। বিলে প্রচুর শামুক, মাছ ও ব্যাঙ রয়েছে। বিলের মধ্যে কোলাহলমুক্ত বাড়িটি দীর্ঘদিন থেকেই পাখিদের নিরাপদ আবাস। বক ছাড়াও ওই বাড়িতে মিলছে মাছরাঙা, চিল, বাজপাখি, কাঠ ঠোকরা, ঘুঘু, টিয়াসহ বিলুপ্ত প্রায় অনেক পাখি। প্রকৃতির এই নিরীহ পাখিগুলো নিরাপদে থাকে ওই জজ পরিবারে।
এ ব্যাপারে শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ফকির শহীদ বলেন, নির্জন ওই বাড়িতে কোন রকম ভয়-ভীতি নেই বলে বাড়িটি পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। ওই বাড়িতে বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় অসংখ্য পাখির দেখা মেলে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধানে এ জেলায় ৩৩১ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গেলেও ময়ুরপক্সক্ষী বকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মূলতঃ প্রজননকালে বকের পালক, রঙ পরিবর্তন হয়। মাথার উপর দিয়েও পালক বের হয়। এজন্য তখন বকটিকে ভিন্নতর মনে হয়। তিনি বলেন, যত্রতত্র গাছ কেটে ফেলায় পাখিরা বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। কাজেই খালবিলসহ পাখির নিরাপদ স্থানগুলোতে শিকার বা নিধন বন্ধের পাশাপাশি তাদের আশ্রয়স্থল বড় গাছগুলো রক্ষা করতে হবে। তবেই এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠতে পারে পাখি বাড়ি। তৈরি হতে পারে ভিন্ন পরিবেশ।
