শেরপুরে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য পৌষ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শহরের নবীনগর ছাওয়াল পীরের দরগা সংলগ্ন খোলা মাঠে আয়োজিত এই মেলা ২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে চলে রাত পর্যন্ত। মেলায় প্রতি বছরের মতো শিশু, নারী ও পুরুষসহ সব বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়। আয়োজক ও স্থানীয়দের দাবি, ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসছে এই পৌষ মেলা। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য এই মেলা ধরে রাখার প্রত্যয় জানিয়েছেন আয়োজকরা।

মেলার আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর এই মেলাটি মূলত ৩০ শে পৌষ অনুষ্ঠিত হলেও কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদের জন্য সংক্রান্তির আগেই আয়োজন করা হচ্ছে। পৌষ মেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নিমকি, গজা, খোরমা, কলাই, চানাচুর, বাদাম কটকটি, তিলের খাজা এবং প্লাস্টিক ও মাটির তৈরি শিশুদের বিভিন্ন খেলনা ও নারীদের বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীর পাশাপাশি গৃহস্থালির বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসে।
পৌষ মেলার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ঘোড়দৌড়, সাইকেল রেস ও গাঙ্গী বা কুস্তি খেলা। বড়-মাঝারি-ছোট এ তিনটি গ্রুপে অনুষ্ঠিত হয় গাঙ্গী খেলা। আর আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসেন ২০ জন ঘোড়সওয়ার। এখন এসব খেলার সাথে যুক্ত হয়েছে নারীদের মিউজিক্যাল চেয়ার, বালিশ খেলাসহ নানা গ্রামীণ বিভিন্ন খেলা ও প্রতিযোগিতা। মেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

এদিকে মেলাকে ঘিরে শেরপুর শহরের নবীনগরসহ আশেপাশের এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ মেলাকে কেন্দ্র করে নবীনগর ও আশেপাশের এলাকার মেয়েরা স্বামী-সন্তানসহ বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন। এসব এলাকায় নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সের হাজারো মানুষের ঢল নামে। স্থানীয়দের ঘরে ঘরে চলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে প্রায় প্রতি বাড়িতেই দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা ছুটে আসে পিঠা খেতে এবং মেলা দেখতে। এক সময় বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখতে পূর্ব পুরুষদের রেওয়াজ অনুযায়ী আশপাশের গ্রামের মানুষ ভোরে উঠে হলুদ ও সর্ষেবাটা দিয়ে গোসল করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় এই প্রথা হারিয়ে গেছে।
শেরপুর শহরের অষ্টমীতলার বাসিন্দা মো. আলামিন জানান, শহর ঘেঁষে এত সুন্দর এই মেলার আয়োজন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আমরা চাই মেলার পরিসর ও সময় আরও বাড়ানো হোক। তাতে শহরের ছেলেমেয়েরা মন খুলে আনন্দ করতে পারবে। মেলায় ঘুরতে আসা ব্যবসায়ী মো. আসাদ বলেন, আমি খবর পেলেই কাজ ফেলে হলেও প্রতি বছর নকলা থেকে এই মেলা দেখতে আসি। এখানকার মুখরোচক গ্রামীণ খাবার কিনে নিয়ে যাই ছেলেমেয়ের জন্য। এছাড়া খেলাধুলা উপভোগ করি।
মেলায় প্রথমবারের মতো স্বামীর সাথে ঘুরতে এসেছেন শহরের ঢাকলহাটী এলাকার বাসিন্দা ইসরাত জাহান মিতু। তিনি জানান, শহরের পাশেই এত সুন্দর এই মেলায় এর আগে কখনও আসা হয়নি। আজকে এসে মেলায় ঘুরে বেশ আনন্দ লাগছে। বিশেষ করে নারীদের জন্যও খেলার আয়োজন থাকায় আয়োজকদের ধন্যবাদ। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলায় অংশ নেওয়া তরুণী মারুফা আক্তার বিথী বলেন, প্রতি বছরই তিনি সপরিবারে মেলায় এসে খেলায় অংশ নেন। মেলার জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকার পর এখানে এসে তার খুব ভালো লাগে।নবীনগর এলাকার কিশোরী বিন্দু জানান, তিনি ছোট থেকেই বাবা-মার সাথে মেলায় আসেন। অন্যসব মেলার চাইতে এখানকার আয়োজন অনেক ব্যতিক্রম। এখানে বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন থাকে। তাই এই মেলার আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন তিনিসহ এলাকার অন্যান্য শিশু-কিশোররা।মেলায় ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি আরও বড় পরিসরে অনুষ্ঠানের দাবি জানান মেলায় আসা দর্শনার্থীরা।
নবীনগর পৌষ মেলা আয়োজক কমিটির অন্যতম সমন্বয়কারী ও শেরপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম জানান, আমাদের বাপ দাদার আমল থেকে প্রতিবছর বাংলা পৌষ মাসের শেষদিন (পঞ্জিকা মতে) ছাওয়াল পীরের দরগাহ সংলগ্ন মাঠে এ পৌষমেলা অনুষ্ঠিত হতো। তবে এখন সময় একটু এগিয়ে আনা হয়েছে। আমরা ছোট থেকেই শুনে আসছি কয়েকশ বছর যাবৎ এ মেলা হচ্ছে। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে শেখ মমতাজ আলীর নেতৃত্বে মেলা উদযাপন কমিটি প্রতিবছরই এ পৌষমেলার আয়োজন করবে।
