বালাদেশ ষড়ঋতুর দেশ; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিÑ চিরহরিৎ এক দেশ। এদেশের প্রকৃতির অন্যতম প্রধান ঋতু শীত। শীতের আগমনী বার্তা যেন বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এক ভিন্নরকম চাঞ্চল্যতা নিয়ে আসে। শীত বাংলা বর্ষপঞ্জির পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ মাস মিলে হয় শীতকাল। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক এবং দিনের তুলনায় রাত দীর্ঘ হয়। মেরু এবং নাতিষীতোষ্ণ জলবায়ুতে শীতকাল বছরের শীতলতম ঋতু। এটি শরতের পরে এবং বসন্তের আগে আগমন করে। পৃথিবী অক্ষের ঘুর্ণন ঋতুর উদ্ভব ঘটায়। শীতকাল আসে যখন কোনো গোলার্ধ সূর্য থেকে দূরে থাকে।

বাংলার ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় এর প্রকৃতি ও জীবন। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের আমেজ শুরু হয়ে যায়। তখন উত্তর দিকে হিমালয় অঞ্চল থেকে শীত নামানো হাওয়া আসতে শুরু করে। প্রকৃতির এই পালাবদলে ষড়ঋতুর পথ পরিক্রমায় শুরু হলো শীতকাল। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হলো বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অন্যতম প্রধান এ ঋতু। প্রকৃতি এসময়ই শীতের পরশ বুলিয়ে যাওয়া শুরু করে। দিনে সূর্যের তাপের প্রখরতাও কমতে থাকে। সকালের কোমল রোদে শিশির বিন্দু মুক্তোদানার মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। মাঠে-ঘাটে শ্রমজীবিরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পায়। পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলে পড়লে আরামবোধ যেন আরও বেড়ে যায়। সকালের মতোই সন্ধ্যার পল্লী যেন নীল কুয়াশার আঁচলে আচ্ছাদিত হয়ে যায় পরম মমতায়। গ্রামবাংলা তো বটেই, শহরেও এ সময় কখনো বয়ে যায় শিরশিরে উত্তরা সমীরণ। রাত যত বাড়ে, তত শীতের অনুভবও বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতির এই পরিবর্তন বার্তা দিয়ে যায় এই বুঝি শীত এসে গেলো।
প্রতিবছর শীতের এ আগমনী বার্তা যেন প্রকৃতিতে এক ভিন্ন রকম চাঞ্চল্য নিয়ে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে ষড়ঋতুর মধ্যে চারটি ঋতু উপলব্ধি করা যাচ্ছে। হেমন্ত এবং বসন্তের প্রকৃত রূপ হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে হেমন্ত শেষে শুরু হয়ে গেছে শীতের আমেজ।

এবার আগেভাগেই শীত এসে কড়া নাড়ছে প্রকৃতিতে আর শীত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে হিমেল আবহ। মাঝ রাত থেকেই শীত অনুভূত হচ্ছে। গাঁয়ের শিশিরসিক্ত মেঠো পথে জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। সন্ধ্যার প্রকৃতি ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার হালকা চাদরে। সকালের শিশিরভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতি সিক্ত হচ্ছে। গাছের পাতা, ধান গাছ ও ঘাসের ডগায় ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু পথচারীদের আকৃষ্ট করছে। সূর্যের কিরণে তা মুক্তো দানার মতো ঝকঝক করছে। শুধু ধানের ডগায় শিশির বিন্দু নয় ফুলের রাজ্যে গন্ধরাজ, গাঁদা, মল্লিকা, শিউলি, ডালিয়া, কামিনী, দেবকাঞ্চন, সূর্যমুখী, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুলসহ আরো কয়েক প্রজাতির ফুল প্রকৃতিকে মুগ্ধ করছে। ফলে গ্রাম বাংলায় তথা দেশের উত্তরাঞ্চলে মাঝ রাত থেকেই শীত অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যা রাতে হালকা গরম অনুভব হলেও মাঝ রাতের দিকে কাঁথামুড়ি দিতে হচ্ছে পল্লীবাসীদের। ভোর থেকেই চারপাশে কুয়াশা দেখা গেলে সূর্য ওঠার একটু পরেই তা কাটতে শুরু করে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ ঋতুতেই প্রধান ফসল ধান ঘরে ওঠে। মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, কৃষক-কৃষাণীর আনন্দÑ এ সবই এ ঋতুর রূপের অনিবার্য অনুষঙ্গ। সারা বছরের মহাজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাওনা পরিশোধের সুযোগ হয় ফসল ঘরে ওঠার পরেই। কৃষকের সারা বছরের অন্নজোগানও আসে এ সময়। বাঙালির জীবন মানসে এ ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
এ সময় খেজুরের রস দিয়ে বানানো হয় নানা রকম পিঠাপুলি। নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যেতে থাকে। এ সময় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর শিশু-কিশোরদের মাঝে চড়ুইভাতির ধুম পড়ে যায়। ভোর হওয়ার আগে থেকেই গ্রামে কৃষাণীদের ধান সিদ্ধ করা, মাঠে ব্যস্ত কৃষক নতুন করে ফসল ফলানোর, শীত থেকে রক্ষা পেতে আগুন পোহানোÑ এসবই ধরা পরে চিরায়ত শীতের রূপ হিসাবে রূপসী বাংলাদেশে।
গ্রামবাংলায় শীতের আগমনী বার্তার সাথে পাল্লা দিয়ে শীত নিবারণের উপকরণ লেপ-তোষক তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কারিগররা। এ সময় লেপ-তোষক কারিগর ও ব্যবসায়ীদের মাঝে কর্মচঞ্চলতা ফিরে এসেছে। কারণ প্রতিটি এলাকাতেই শীত জেঁকে বসার আগেই শীত নিবারণে ওইসব লেপ-তোষক তৈরির দোকানে ভিড় করছে এ অঞ্চলের মানুষ। সারা বছরের মধ্যে এ শীত মৌসুমেই কারিগরেরা কাজের বেশি অর্ডার পান। ফলে এ সময় তাদের কাজ বেশি করতে হয়।
অপরদিকে শীত মৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন গ্রাম্য পরিবারের গৃহবধূরা কাঁথা সেলাই শুরু করে দেন। গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহর অঞ্চলে অনেক পরিবার রয়েছে, যারা কাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আবার গরীব পরিবারের মহিলারা পুরনো শাড়ি, লুঙ্গি দিয়ে কাঁথা তৈরি করে থাকেন। তাদের লেপ-তোষকের স্বাদ থাকলেও অনেকের সাধ্য না থাকায় রঙ-বেরঙের সুতা ও কাপড় দিয়ে কাঁথা বুনেন তীব্র হাড় কাঁপানো শীতের কবল থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য।
ভোরের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে মিষ্টি রোদ আর সবুজ ঘাসের পাতার ওপর শিশির বিন্দু জানিয়ে দেয় দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। এখন প্রতিদিন ভোরে বিভিন্ন জায়গায় দেখা মিলছে কুয়াশার। ফসলের মাঠে উঁকি দিচ্ছে নতুন বীজের প্রস্ফুটিত চারা। তাতে শিশির বিন্দু ছড়িয়ে দিচ্ছে মৃদু শীতলতা। এ সময় মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয় হলদেবরণ সরষে ক্ষেত আর নানা প্রজাতির ফুলের বাগান। এদিকে শীতের আগাম সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষকরা। লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, বেগুন, ডাটা, বরবটি, গোল আলু, মটরশুটি, শালগম, ওলকপি, মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, লাউ, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের আগাম শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে।
প্রকৃতির এই রূপ অনেকের কাছেই প্রিয়। তাই এই মৃদু শীত শীত ভাব অনেক বাঙালির কাছেই প্রিয় একটি সময়। এখন থেকে দিন যতই গড়াবে পৌষের দিকে ততই সাইবেরিয়ান বায়ুপ্রবাহ বাড়বে এ দেশ অভিমুখে। হিমালয়সংলগ্ন দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে অবশ্য ইতোমধ্যে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। এখন থেকে ধীরে ধীরে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি বাড়ছে কুয়াশার প্রকোপ। যে কারণে সেখানে গোধূলিলগ্নে দেখা মেলে কুয়াশার। আবার কোথাও সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশা এমনভাবে বিস্তৃত হয় যে, তা দৃষ্টিসীমা হরণ করার উপক্রম হয়। রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আগমন ঘটে তখন গাঢ় কুয়াশার দেখা মেলে কোথাও। তার মধ্যেই উঁকি দেয় ভোরের নবীন সূর্য। শীতের এই অনুভূতি উপভোগ করতে ইতোমধ্যে রূপসী বাংলার ঘরে ঘরে তুলে রাখা নিজ হাতে সেলাই করা পাতলা কাঁথা আর চাদর-কম্বল স্থান পেতে শুরু করেছে খাট-চৌকিতে।
ইট-পাথরের শহরের চিত্র অবশ্য আলাদা। এখানে ভরা শীত মৌসুমেও তেমন শীতের তীব্রতা অনুভূত হয় না। প্রায় বারো মাসই গরম গরম একটা ভাব থাকে এখানে। তারপরেও পৌষের দিনগুলোতে প্রত্যন্ত গ্রামের আবহাওয়া বিরাজ করে শহরাঞ্চলে। অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশের মতো পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায় অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারেন না। যে কারণে কেউ কেউ সর্দি-জ্বর, কাশিসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সব বয়সির মধ্যে এই সমস্যা দেখা গেলেও শিশু আর বয়স্করা একটু বেশি নাজুক হয়ে পড়ে এ সময়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রায় প্রতি বছরই শীতের হানা দেয় দেশের উত্তরাঞ্চলসহ গ্রামাঞ্চলে। বিশেষ করে লা নিনো ও দুর্বল (পোলার ভরটেক্স) মেরু ঘুর্ণির কারণে বাংলাদেশসহ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে শৈত্যপ্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। পোলার ভরটেক্স তথা মেরু ঘুর্ণি হচ্ছেÑ পৃথিবীর উভয় মেরু অঞ্চলের বিশাল অঞ্চলের লঘুচাপ এবং ঠাণ্ডা বায়ুর এলাকা। এটা সব সময় মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থান করে এবং গ্রীষ্মে দুর্বল হয়ে যায় ও শীতে শক্তিশালী হয়। মেরু অঞ্চলের কাছের বায়ুমণ্ডলে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে মেরু অঞ্চলের পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। অনেক সময় উত্তর গোলার্ধের ভরটেক্সেও সম্প্রসারণ ঘটে এবং জেট স্ট্রিমের (খুবই ঠাণ্ডা বায়ুপ্রবাহ) সঙ্গে ঠাণ্ডা বায়ু দক্ষিণ দিকে পাঠিয়ে থাকে। পরিবেশবিদদের মতে, নিরক্ষীয় বায়ুর প্রভাবে সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল স্রোত তৈরি হয়। প্রশান্ত মহাসাগরে ইতিমধ্যে এই স্রোত দেখা দিয়েছে। যার জন্য উত্তর নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণতা কমতে শুরু করেছে। সেই লা নিনোর প্রভাবেই এখন এ অঞ্চলে শীত পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের এবং কিছু মানুষের কাছে শীতকাল কিছুটা নিস্তেজ এবং বিরক্তিকর বলে মনে হয়। যেহেতু ঠাণ্ডা থাকার কারণে আমাদের ঘরের বাইরে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়ে যায়; লেপ-কম্বল আর বিছানা ছেড়ে যেনো কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেই করে না। আবার কারো কারো মতে শীত ঋতুই পর্যটনের জন্য সেরা ঋতু। প্রয়োজনে ভারী পোশাক পরে কোথাও যাওয়া হলেও তেমন কোনো সমস্যা হয় না। যেহেতু এ সময় আবহাওয়া শীতল থাকে তাই কোথাও ঘুরতে গেলেও গরমকালের মতো অস্বস্তি বোধ হয় না। তাছাড়া আজকাল শীতের কাপড়গুলো ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের পাওয়া যায়; তাই সেগুলোর মধ্য দিয়ে ফ্যাশনের কোনো কমতি থাকে না। ফলে শীতের কাপড়ে ঘুরতে যাওয়া নিয়েও কারো কোনো দ্বিধা থাকে না। তাই এই শীত ঋতু বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকেরই প্রিয় ঋতু।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর, Email: dr.alim1978@gmail.com.
