শুভ জন্মদিন নকলা।
নকলা’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
“নকলা” নামটি এসেছে, আরবী ‘নাখলা’ শব্দ থেকে।
নাখলার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
সৌদি আরবের মক্কা এবং তাইফ নগরীর মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম “নাখলা”। ইসলাম ধর্মের নবী মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীদের সপ্তম মরুযাত্রী আক্রমণ এবং মক্কার কুরাইশ দের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম সফল অভিযান সংগঠিত হওয়ায় নাখলা বিখ্যাত স্থান। নাখলার বর্তমান নাম হেজাজ। খেজুর গাছের আরবি নাম ‘নাখল’। নাখলের বহুবচন নাখলা।

নকলা নামকরণ :
আরবী ‘নাখলা’ শব্দ থেকে “নকলা” নামের উদ্ভব। নকলায় প্রচার আছে নাখলা শব্দের অর্থ খেজুরের বাগান। কিন্তু অনলাইনের আরবি ডিকশনারিতে নাখলা শব্দ ও শব্দের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করছি আঞ্চলিক ভাষায় “নাখলা’র পরিবর্তিত নাম নকলা”। আঞ্চলিক ভাষায় নকলাকে, নলহা বা নখলা বলে ডাকা হয়।
নকলা থানা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :
বর্তমান নকলা থানা পূর্বে নালিতাবাড়ী থানার অন্তর্গত ছিলো। নদী, পাহাড়, জঙ্গল, খাল, বিল, সমতল ও চরাঞ্চল সহ বিশাল এলাকাজুড়ে নালিতাবাড়ী থানা। যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌকা, গরুর গাড়ি, ধনী শ্রেণির মানুষ ঘোড়ায় চলতেন, তবে সংখ্যায় খুব কম। বেশীরভাগ মানুষ হেঁটেই চলতো। মূল বিষয় যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল। নালিতাবাড়ী থানা সদর থেকে নকলার প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন খুব কঠিন বিধায়, ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক প্রয়োজনে ১৯২২ সালের ১২ নভেম্বর, তৎকালীন নালিতাবাড়ী থানার, দক্ষিণাঞ্চলের, গণপদ্দী, নকলা, উরফা, কুর্শা বাদাগৈড় (বর্তমানে গৌড়দ্বার), বানেশ্বর্দী, পাঠাকাটা, টালকী, চরঅষ্টধর এবং চন্দ্রকোনা, মোট নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে নকলা থানা প্রতিষ্ঠা করে।
(বাংলাপিডিয়ায় লেখা রয়েছে, ১৯৩০ সনে নকলা থানা হয়েছে।) বানেশ্বর্দী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মশিউর রহমান সফিক জানালেন নকলা থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩১ সনে। মূল তারিখ খুঁজে বের করে সকলের অবগতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৯৮৪ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের ২২ তারিখে নকলা থানাকে প্রথমে মান উন্নীত থানা এবং কিছুদিন পরে উপজেলা ঘোষণা করা হয়।
শেরপুর জেলাধীন নকলা উপজেলা ১৯৭৮ সন থেকে ১৯৮৪ সনের ফেব্রুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত জামালপুর জেলা ও তৎপূর্বে ময়মনসিংহ জেলার আওতাভুক্ত থানা ছিলো।

নকলা থানা সদর প্রতিষ্ঠা :
সূবর্ণ খালী নদীর তীরে কুর্শা বাদাগৈড় ইউনিয়নের ইশিবপুর মৌজায় নকলা থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা সদর এলাকা পৌরসভায় উন্নীত হওয়ায় কুর্শা বাদাগৈড় ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৌরসভার বাহিরে থাকা কুর্শা বাদাগৈড় ইউনিয়নের বাকী অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছে গৌরদ্বার ইউনিয়ন। কুর্শা ও বাদাগৈড় নামে পৌরসভার ভিতরে দুইটি মহল্লা আছে। নকলা থানা সদর কুর্শা বাদাগৈড় ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর উত্তর সীমানায় নকলা নামে একটি আলাদা ইউনিয়ন আছে।
নকলা উপজেলার সীমানা :
উত্তরে নালিতাবাড়ী থানা, দক্ষিণে ময়মনসিংহ সদর (কোতোয়ালি) ও জামালপুর সদর উপজেলা, পূর্বে ফুলপুর এবং পশ্চিমে শেরপুর সদর থানা। নকলা উপজেলার পূর্ব উত্তর কোনায় তারাকান্দা গ্রামের সাথে হালুয়াঘাট উপজেলার মোকামিয়া গ্রামের সীমান্ত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় নকলা উপজেলাটি দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে তিনটি জেলার সদর থানা পরিবেষ্টিত। আমার জানামতে তিন জেলা পরিবেষ্টিত সীমানাগত এমন অবস্থান অন্য কোন উপজেলার নাই।
নকলার প্রসিদ্ধ স্থান সমূহ :
চন্দ্রকোনা, নারায়ণখোলা, গনপদ্দী, শিববাড়ি ও পাঠাকাটায় প্রাচীন ঐতিহ্য বিদ্যমান। বিবিরচর বিখ্যাত, নকলা উপজেলার প্রথম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিবিরচর রহমানিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার জন্য।
নারায়ণখোলা ও চন্দ্রকোনা :
মোঘল আমলে নারায়নখোলা গ্রামে সেনা ছাউনী ছিল। স্থলপথে ব্যবসা বানিজ্য ও চলাচলের লক্ষ্যে, বৃটিশ শাসনামলে শেরপুর থেকে চন্দকোনা হয়ে নারায়ণ খোলা পশ্চিম পাড়ার ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর পর্যন্ত একটি বড়মাপের কাঁচা সড়ক নির্মিত হয়। নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনা অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদে অঘোষিত নদীবন্দর ছিলো। মূলত শতবছর যাবত নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনা ব্যবসায়ীক মালামাল আনা নেয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিলো। নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনার অপর পারে পিয়ারপুর রেলওয়ে স্টেশন। রেলগাড়ীতে আসা যাত্রী ও মালামাল এই দুই অঞ্চল দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরাঞ্চলে যাতায়াত করতো। শতবছর পূর্ব থেকে উক্ত বাজার দু’টিতে মহাজনী ব্যবসা ছিলো। বাজারের সন্নিকটে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল থাকায় চরে উৎপাদিত ফসলের বড় বাজার ছিলো নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনা।
চন্দ্রকোনা :
লোকমুখে শুনা যায় ব্রিটিশ সরকার, নকলা থানা স্থাপনের পূর্বে প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র ও নৌ বন্দর চন্দ্রকোনায় থানা স্থাপন করতে চেয়েছিলো।
চন্দ্রকোনায় এই অঞ্চলের জমিদার মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরী ও জমিদার গোপাল দাস চৌধুরীর খাজনা আদায়ের জন্য দুটি কাঁচারী স্থাপন করেছিলো। ব্রহ্মপুত্র, দশানি ও মৃগী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত চন্দ্রকোনা নৌ বন্দর থেকে, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কলকাতা সহ ভারতের বহু শহরের সাথে নৌযোগাযোগ ছিলো। লঞ্চের যুগে পাট কল মালিক, পাট ব্যবসায়ী ও পাট ক্রয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত বড় কর্মকর্তারা ছোট লঞ্চে মাঝে মাঝে পাটের বাজার পরিদর্শনে আসতো।
১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন বিদ্যাপিঠ চন্দ্রকোনা রাজলক্ষী উচ্চ বিদ্যালয়, নকলার প্রথম উচ্চ বিদ্যালয়। সূর্যবালা দেবী হাসপাতাল, পোস্ট অফিস এবং বড় বড় পাট ক্রয় কেন্দ্রের জন্য এই এলাকার মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে ছিল। শেরপুর ও নকলার সাথে যোগাযোগের জন্য চন্দ্রকোনা থেকে কাঁচা রাস্তা ছিলো। ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগঠিত, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করা নগেন্দ্র চন্দ্র মোদক, যোগেশ চন্দ্রকর্মকার এবং মন্মথ দে চন্দ্রকোনার সন্তান। এলাকায় প্রচার আছে উক্ত তিন বিপ্লবী ও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট নেতা আন্দামান জেল ফেরত। কিন্তু আন্দামান সেলুলার জেল থেকে আমার সংগৃহীত তালিকায় তাদের নাম নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে তারা আন্দামান জেল ফেরত নহে। হয়ত ভুল বশত তাদের নাম বাদ পরেছে বা যে কোন কারণে বাদ পরেছে। পারিবারিক ও এলাকাবাসী সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মিথ্যা হবার সুযোগ নেই।
নারায়ণখোলা :
ব্রহ্মপুত্র নদের কূল জুড়ে চর অষ্টধর ইউনিয়নের অবস্থান। এই ইউনিয়নের প্রসিদ্ধ বানিজ্যিক স্থান নারায়ণ খোলা বাজার। নৌকাযোগে পাট/ধান ও বানিজ্যিক মালামাল সরবরাহের জন্য নারায়ণ খোলা গুদারা ঘাটও বিখ্যাত ছিলো। বর্তমানে জামালপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত পিয়ার পুর রেলওয়ে স্টেশন ও বাজার নারায়ণ খোলা থেকে কাছে। পিয়ার পুর বাজারে প্রায় সব জুট মিলের গোডাউন ছিলো। এখানে মহাজনদের নিকট থেকে পাট ক্রয় করে বিশাল বিশাল নৌকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ সহ বিভিন্ন পাটকলে পাঠানো হতো। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পিয়ার পুর বেশ দুরে ছিলো। নদের ঐ তীরে কোন বাড়ীঘর না থাকায় নিরাপত্তার অভাব ছিলো। নিরাপত্তা ও দুরত্ব কমের কারণে নৌকা মালিক, মাঝি ও পাট ব্যবসায়ীদের নিকটে নারায়ণ খোলা গুদারা ঘাটের গুরুত্ব ছিলো অনেক বেশী।
নারায়ণখোলা ঘাটের আশেপাশের মানুষ নৌকা ও মালামালের নিরাপত্তা দিতো। ঘাটের আশেপাশের মানুষ নৌকার মালামাল উঠানামার শ্রমিক হিসাবে কাজ করতো, গরুর গাড়িতে করে পাট ও মালামাল আনা-নেওয়া করতো, পান-বিড়ির দোকানদারি সহ প্রয়োজনীয় বহু রকমের কাজকারবার করতো। রাতদিন সবসময় ঘাট এলাকা থাকতো জমজমাট। বিশাল সাইজের নৌকার সৌন্দর্য দিলো দেখার মত। ৫০০ মণী হাজার মণী নৌকা এই ঘাটে ভিরতো। এসব নৌকার তলদেশে নামতে হতো কাঠের বা বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে। যতবড় নৌকা ততবড় সিঁড়ি। একেকটা নৌকায় ২০/২৫ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতো। নৌকার দুই ধারে বাঁশ দিয়ে মেঠোপথের মত নৌকা বাইবার পথ থাকতো, বড় বড় লগি দিয়ে একেক পাশে ৪/৫ জন বা আরও বেশী মাঝি হেঁটে হেঁটে নৌকা চালাতো, কাঠের তৈরী বিশাল হাল নিয়ে ছইয়ের উপরে বসে গতি পথ নির্ধারন করতো মূল মাঝি। ১৯৮০ সন পর্যন্ত এসব আমি নিজে দেখেছি। আমরা স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এসব নৌকায় উঠে অনেক মজা করতাম। এখন এসব রূপকথার গল্পের মত মনে হয়।
নারায়ণখোলার সরকার পরিবার একটি বিখ্যাত পরিবার। নারায়ণখোলায় জমিদারদের ও সরকারের দৃষ্টি না থাকলেও সরকার পরিবারের সদিচ্ছায় ও উদ্যোগে ১৯১৪ সালে নারায়ণখোলা প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার পরিবারের উদ্যোগে এবং তাঁদের দান করা জমিতে ১৯৬৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণখোলা জুনিয়র স্কুল। স্বাধীনতার পরে জুনিয়র স্কুলটিকে, উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। নারায়ণখোলা বাজারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকার পরিবারের জমিতে। এই এলাকার ভূস্বামী মরহুম আজিবুল্লাহ সরকারের পুত্র মরহুম আবদুল গনি সরকার ও মরহুম আবদুল আজিজ সরকারের উদ্যোগে এলাকার বেশীরভাগ উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। বৃটিশ আমলে নারায়ণ খোলা থেকে নকলা, গৌড়দ্বার ও ফুলপুর যাতায়াতের কাঁচা রাস্তা ছিলো।
নারায়ণখোলার আরেকটি বিখ্যাত স্থান বেড় শিমুল গাছ, হালে নাম শিমুলতলা। বিশাল এলাকাজুড়ে গাছটির প্রশস্ততা (বেড়) থাকায় স্থানীয় ভাষায় প্রশ্বস্ততাকে বেড় বা বের বলা হয়। এই গাছটি নিয়ে অনেক রূপকথা বা কল্প কাহিনী আছে। আমি স্কুল-কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট থেকে যা শুনতাম তা তুলে ধরছি।
এই শিমুল গাছের নীচে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের আড়াই দিনের খাবারের সমপরিমাণ ধনসম্পদ আছে। এই গাছের নীচে সোনা নির্মিত নৌকা আছে। স্বর্ণ নির্মিত কলার ছড়ি আছে। এখানে গান বাজনার শব্দ শোনা যেতো। কিন্তু গায়ক গায়িকা দেখা যেতো না। আরও একটি গল্প প্রচারিত ছিলো, আমার নানি আমাকে বেশী বেশী শোনাতো। কারণ বাস্তবে আমার ভুত দেখার খুব সখ ছিলো। আমি এই গাছের নীচে দিনরাত ২৪ ঘন্টাও সময় কাটিয়েছি। এই অভিজ্ঞতা অন্য দিন লিখবো। এখন গল্পটি লিখছি। একদিন একটি ছেলে এই গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, একজন সুন্দরী মেয়ে ছেলেটিকে একটি কলা খাইয়ে কাউকে না জানানোর জন্য ভয় দেখায়। মেয়েটি ছেলেটিকে বলে যদি কলা খাওয়ার কথা কাউকে বল, তবে তোমার ক্ষতি হবে। ছেলেটি কলা খাবার পর থেকে তার ক্ষুধা নিবারণ হয়ে যায়। ক্ষুধা না থাকায় সে কিছুই খেতো না। ছেলেটির মা এই ঘটনায় বিচলিত হয়। মা বাবার অনুরোধে ছেলেটি একদিন কলা খাওয়ার ঘটনাটি প্রকাশ করে দেয় এবং সাথে সাথে তার গলা দিয়ে পূর্ণ কলাটি বের হয়ে আসে এবং ছেলেটি তৎক্ষনাৎ মারা যায়। আমি বহু চেষ্টা করেও এই ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাইনি।এখানে দুটি শিমুল গাছ ছিলো। একটি শিমুল গাছ বিক্রি করার পর ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে নৌকার মত চালিয়ে নেয়ার সময় কোন প্রকার ঝড় তুফান ব্যতীত সকল মাঝি মারা যায় এবং গাছটি উধাও হয়ে যায় বলে ব্যাপক প্রচার আছে কিন্তু কোন তথ্য প্রমাণ নেই। এসব কারণে গাছটির প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক উৎসাহ। এখানে অনেকেই মনের আশা পূরণের জন্য হাস, মুরগী, ছাগল, গরু ও টাকা পয়সা দান করে।
নকলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় :
নকলা ইউনিয়নের স্বনামধন্য ব্যক্তি মরহুম মৌলভী আতাউর রহমান ১৯২২ সনে তাঁর নিজগ্রাম ধুকুরিয়ায়, আফজালুন নেছা গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সনে মৌলভী আতাউর রহমান উক্ত গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ধুকুরিয়া এম ই স্কুল। পরের বছর গনপদ্দীতে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে, নকলা থানা সদরের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মৌলভী সাহেবকে স্কুলটি নকলায় স্থানান্তরের আহবান জানান। মৌলভী সাহেব রাজী না হলে বহু দেনদরবারের পর মৌলভী সাহেবের শ্বশুরের মধ্যস্থতায় কয়েকটি শর্তের বিনিময়ে, ১৯৪৭ সনে স্কুলটি নকলা সদরে স্থানান্তরিত হয়। শর্ত, তার নিজ জমিতে স্কুল হতে হবে, তাঁকে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি রাখতে হবে। নকলাবাসী শর্তে রাজী হবার পর মৌলভী সাহেবের ৬৫ শতাংশ জমিতে স্কুলটি পূনঃস্থাপন করা হয়। স্কুল টির বর্তমান নাম নকলা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। এই তথ্যগুলো নেয়া হয়েছে মৌলভী আতাউর রহমানের নাতি অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বিদ্যুৎ ও নকলা থেকে নির্বাচিত শেরপুর জেলা পরিষদের মেম্বার ছানোয়ার হোসেনের কাছ থেকে।
গনপদ্দী :
চন্দ্রকোনা ও ধুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পরে ১৯৩৮ সনে গনপদ্দীতে প্রতিষ্টিত হয় চতুর্থ উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ডাক্তার শরাফত উদ্দীন আহমদ। শরাফত ডাক্তার ১৯৬৫ সনে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। শরাফত ডাক্তারের পরিবারও নকলার ঐতিহ্যবাহী পরিবার। ডাক্তার সাহেবের মেয়ের জামাই মরহুম খন্দকার মিজানুর রহমান আকালনুবী এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কৈ মাছের জন্য এখানে কৈয়ের বিল ও কৈয়ের বাজার বিখ্যাত ছিলো কিন্তু এখন কৈ মাছের আকাল। স্কুলের তথ্য দিয়েছেন খন্দকার মশিউর রহমান সফিক চেয়ারম্যান।
পাঠাকাটা :
ব্রিটিশ আমলে পাঠাকাটা ইউনিয়নে নীল কুঠি ছিলো। আমি ছোটকালে এখানে জরাজীর্ণ ভবন দেখেছি বলে আবছা মনে পরে। এখন ভবনের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও একটি পুকুর রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম পুকুরটি বর্তমানে মাছ চাষের জন্য সরকার থেকে লীজ দেয়া হয়।
শিববাড়ি বাজার :
নকলা ইউনিয়নের বলেশ্বর নদীর পূর্ব তীরে নকলা মৌজায় অবস্থিত বিখ্যাত শিববাড়ি বাজার। শিববাড়ি নাম থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, আগে এখানে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ব্রিটিশ আমলে এ বাজারটি বেশ জমজমাট ছিলো বলে বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়।
বিবিরচর :
ভারতের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা গ্রহনকারী প্রখ্যাত আলেম, আলহাজ্ব ফজলুর রহমান, (বড় হুজুর) ১৯৩৫ সনে বৃটিশ শাসনামলে স্ব-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন বিবিরচর রহমানিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা। বড় হুজুর এলাকাবাসীর দেয়া খেতাব। ফজলুর রহমান সাহেব অত্রাঞ্চলে বড় হুজুর নামেই পরিচিত। আমার বাবা আলহাজ আবদুল হাই এই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। এটি নকলা থানার প্রথম মাদ্রাসা।
নারায়ণখোলা, চন্দ্রকোনা, গনপদ্দী, শিববাড়ি ও আরও কিছু নাম দেখে ধারনা করা যায় অঞ্চলটিতে প্রচুর হিন্দু বসবাস করতো। এখন তেমন নেই।
মুক্তিযুদ্ধে নকলা :
ভারতীয় সীমান্ত নকলার নিকটবর্তী হওয়ায় এবং নকলার দুর্গম ও চরাঞ্চল সমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে এই থানা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। নারায়ণ খোলা, জানকী পুর ও গৌরদ্বার বাজারে তিনটি সন্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিকটে পরাজিত হয়েছে। নারায়ণ খোলা সন্মুখ যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এর মাঝে দুইজন কাজাইকাটা গ্রামের। অন্য একদিন পাকিস্তানি বাহিনী, নারায়ণ খোলার সরকার বাড়ির তিন ভাইকে একসাথে হত্যা করেছে।
জাতীয় সংসদ সদস্য ও জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান :
নকলা থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, সততার মূর্ত প্রতীক মরহুম ডাক্তার নাদেরুজ্জামান খান। পরবর্তী এমপি অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান। তৎপরবর্তী এমপি বেগম মতিয়া চৌধুরী। নকলা থানার বানেশ্বর্দী গ্রামে তাঁর স্বামীর নানা বাড়ি। মতিয়া চৌধুরীর স্বামী বজলুর রহমান নানা বাড়ী থেকে লেখাপড়া করেছেন। পরবর্তীতে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। পরবর্তী এমপি মরহুম আলহাজ্ব জাহেদ আলী চৌধুরী।
মরহুম ডাক্তার শরাফত উদ্দীন আহমদ প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
নকলা থানার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ :
নকলা থানার প্রথম ডাক্তার, মরহুম শরাফত উদ্দীন আহমদ, ক্যাম্বেল মেডিকেল কলেজ কলকাতা। উনি এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন না।
দ্বিতীয় ডাক্তার, মরহুম নাদেরুজ্জামান খান, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। উনি এলএমএফ ডাক্তার ছিলেন।
অধ্যাপক ডাক্তার সোহরাব আলী নকলার প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার। পাঠাকাটা।
মরহুম এডভোকেট শরাফত আলী সরকার নকলার প্রথম এডভোকেট। নারায়ণখোলা।
মরহুম হায়দার আলী নকলার প্রথম ব্যারিষ্টার ও সচিব, সেনেকান্দা, চরঅষ্টধর ইউনিয়ন।
নকলার দ্বিতীয় সচিব, মোঃ নজরুল ইসলাম, চন্দ্রকোনা।
নকলা উপজেলার কোন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কোথাও পাওয়া যায় না। একটি সূত্রের তথ্যমতে, ১২ নভেম্বর নকলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা জন্মদিন উপলক্ষে আমি মাত্র ৮/১০ দিন সময় নিয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে লেখাটি লিখেছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম ও তথ্য বাদ পড়েছে। তাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এত অল্প সময়ে একটি উপজেলার ইতিহাস লেখা সম্ভব না। অতিদ্রুত নকলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নিয়ে হাজির হবার প্রতিশ্রতি দিচ্ছি। সম্মানিত নকলাবাসীকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাধারার লেখক, নকলা, শেরপুর।