কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে দূরদর্শী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করার সুযোগ কম। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, ভবিষ্যতে তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবেন এ বিষয়ে তাঁর নিজের খানিকটা হলেও সংশয় ছিল। তাঁর সেই সংশয়ের কথা আমরা তাঁর নিজের লেখা ‘১৪০০ সাল’ কবিতা থেকে জানতে পারি।
বাংলা ১৩০২ সালের ফাল্গুন মাসে কবির মনে হলো, এই যে তিনি এত গান, কবিতা লিখছেন; সমাজ সংস্কারমূলক গদ্য লিখছেন, সমাজের জন্য কাজ করছেন; এসব কি আগামী এক শ বছর পরের সমাজ বুঝতে পারবে? এক শ বছর পরের বাঙালি কি তাঁর সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে পারবে?
সেই সংশয় থেকে তিনি লিখেছিলেন, ‘১৪০০ সাল’ কবিতা। সেই কবিতায় তিনি এক শ বছর পরের; অর্থাৎ বাংলা ১৪০০ সালের কোনো এক কল্পিত পাঠককে উদ্দেশ করে বলেছিলেন,
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে…
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ-
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে?’
অর্থাৎ তিনি কি এক শ বছর পরের বাঙালির কাছে নিজেকে তুলে ধরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তার সংশয় ছিল।
খুব আনন্দের কথা, তারপর ১২৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবন থেকে মুছে তো যানইনি, বরং আরও উজ্জ্বল হয়েছেন।
শুধু গান, কবিতা, উপন্যাস বা ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে যে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, তা নয়। প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন।
আজকের এই পঁচিশে বৈশাখের শুভক্ষণে কবিগুরুর সাহিত্য নিয়ে এই বাংলা-ওই বাংলায় প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বহু অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাঁর লেখা গান গাওয়া হচ্ছে। তাঁর কবিতা পাঠ হচ্ছে। কিন্তু আমার আলোচনাটি আমি সমাজসংস্কারক রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ধরে রাখতে চাচ্ছি।
সমাজসংস্কারক:
এখন কথা হলো, একটি মানুষ একটি জাতির প্রাত্যহিক জীবনে কখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন? যখন একটি জাতির শিল্প সাহিত্য চর্চা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবন যাপন ও মননকে কেউ প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেন, তখনই তিনি সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথ সেই ধরনের একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সেই কারণে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ বাঙালির আনন্দ উদ্যাপনের দিন।
তাঁর দর্শন ছিল সংস্কারের দর্শন:
ঈশ্বর প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা সংকীর্ণতার নগ্ন বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলেন না। তার কাছে মানুষই ছিল সব থেকে বড় সত্য। এটিই ছিল তাঁর সমাজ দর্শন।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের যখন জন্ম হয়, সেই সময়টাতে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে সাহিত্যে, সমাজসংস্কারে বাঙালি এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল।
উনিশ শতকের প্রাণ পরুষ বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ্যবাদের অমানবিক, নিষ্ঠুর আচার ব্যবস্থাকে ভাঙার কাজে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ প্রচলন থেকে শুরু করে অন্যান্য সামাজিক অপসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ গড়ছিলেন। কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কঠিন শৃঙ্খল ভেদ করার যে সাহসী লড়াইয়ে বিদ্যাসাগর নেমেছিলেন তার প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের চেতনায়, সৃষ্টিযজ্ঞে।
অবিভক্ত বাংলার সামাজিক উত্থান-পতনের এক যুগ সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। ১৭৯৩ খ্রি লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই জমিদার বংশের সন্তান। এক সময় তাঁর ওপর জমিদারি দেখার দায়িত্ব এসে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে তাঁর নিজের জীবন যোগ করার সুবর্ণ সুযোগ আসে। এই সুবাদে দরিদ্র, নিপীড়িত, প্রজাকুলের সঙ্গে তাঁর অকৃত্রিম সৌহার্দ্য আর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।
প্রজাবৎসল জমিদার:
রবীন্দ্রনাথ আর দশজন জমিদারের মতো ছিলেন না। তিনি নিজেই তার নিজের তুলনা ছিলেন। জমিদার হয়েও তিনি যে প্রজা হিতৈষীর ভূমিকা রেখেছিলেন তা অতুলনীয়।
প্রজাদের কল্যাণে তাঁর যে বাস্তব কর্মসূচি সেটা তাঁকে একজন সমাজ গবেষকের সম্মানেও ভূষিত করে। তাঁর সমাজ-চিন্তা-চেতনার সঙ্গে কবির সৃষ্টিযজ্ঞের কোন বিরোধ বা সংঘর্ষ ছিল না। জমিদার সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল-‘পিতৃপ্রতিম অভিভাবক।’
পাশ্চাত্যে ধনবাদী সভ্যতার বিকাশ এবং সারা বিশ্বে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার আগ্রাসনে তিনি যে কতখানি মর্মাহত হয়েছিলেন তা তাঁর বিখ্যাত ‘রক্তকরবী’ নাটকে উঠে এসেছে।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ভাবনা:
ওই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। তখন রাশিয়ায় সবে বিপ্লব হয়েছে। সমাজতন্ত্র এসেছে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া তাকে মুগ্ধ করল। রূপান্তরিত রাশিয়াকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত ও প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ প্রায় করে দিয়েছে, এই সোভিয়েত বিপ্লবীরা তাদের দুটোকেই নির্মূল করে; এত বড় বন্ধন জর্জর জাতিকে এত অল্প কালে এতবড় মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয়। রাশিয়ার পলিটিক্স মুনাফা লোলুপদের লোভের দ্বারা কলুষিত নয়। এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্ববাণী। আজ পৃথিবীতে অন্তত একটা দেশের লোক স্বজাতিক স্বার্থের ওপরেও সমস্ত মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছে।’
সমাজ সম্পর্কে বাস্তবসম্মত চেতনার স্বচ্ছ দলিল যেমন তার মননশীলতায় একইভাবে ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, গীতি ও নৃত্যনাট্যে স্পষ্ট হয়ে আছে।
কৃষি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা:
১৮৯০ সালের রবীন্দ্রনাথ প্রথম পূর্ব বাংলায় আসেন। তার জমিদারি এলাকাধীন বিরামপুর, কলিগ্রাম, শাহাজাদপুর এলাকায় ঘুরে তিনি দেখেন, এখানকার কৃষকেরা বংশানুক্রমিকভাবে মহাজন ও দাদনদারের কাছে ঋণগ্রস্ত। এই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মহাজনী ঋণের শেকল থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল, ১. কৃষকদের নিয়ে সমবায় ভিত্তিক সমিতি ২. শস্য গোলা, ৩. কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ।
সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের মাঝে ঐক্য গড়ে তোলা। সমিতির মাধ্যমে কৃষকেরা যাতে তাদের সমস্যা নির্ধারণ করতে পারে এবং এর সমাধানে কী করণীয় তা নিজেরাই ঠিক করতে পারে তিনি সেই চিন্তা করেছিলেন।
সে সময় মহাজনী ঋণ ছিল চড়া সুদের। তাই স্বল্প সুদে সহজ শর্তে জামানতহীন ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ কৃষি ব্যাংক গড়ে তুলেছিলেন। গরিব কৃষকদের সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য তিনি ১৮৯৪ সালে শিলাইদহে এবং ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কৃষকদের জন্য তৈরি এ ব্যাংক পরিচালনায় যে পদ্ধতি তিনি প্রণয়ন করেছিলেন তাতে ছিল একটি কৃষকবান্ধব ব্যবস্থা। অর্থাৎ গরিব কৃষক যারা এই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করবে এবং সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন তাদের প্রদেয় সুদের একটি অংশের মালিকানা উক্ত ঋণগ্রহীতা হয়ে যাবেন। ব্যাংকটির পরিচলন প্রক্রিয়ায় কৃষকের মতামত গ্রহণ করা হতো।
প্রাথমিক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ তার আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এই ব্যাংকের মূল ধন গড়ে তোলেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল প্রাইজ পান। নোবেল প্রাইজের অর্থ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা পতিসর কৃষি ব্যাংকে অনুদান হিসেবে প্রদান করেন।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন না। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তকও ছিলেন। তাঁর সমাজসংস্কার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যাবে। কিন্তু সেই দীর্ঘ আলাপের যে সার কথা দাঁড়াবে, তা হলো রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সমাজসংস্কারের যে মজবুত ভিত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, সে ভিতের ওপরই গোটা বাঙালি সমাজ আজ গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক : পুলিশ সুপার, শেরপুর।