মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর :

পৌষ শুরু হয়েছে। আর চাষির স্বপ্ন বোনা দিগন্তজোড়া হলুদ বর্ণিল সরিষা ফুলে ভরে গেছে মাঠের পর মাঠ। প্রকৃতিতে এ এক নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন শেরপুরের বিস্তর অঞ্চলজুড়ে। শীতের শুভ্র সকালে বিন্দুবিন্দু শিশিরে টলমল সিক্ত এখন হলুদ ফুলের অঙ্গজুড়ে। সূর্য ওঠার সাথে সাথে শিশিরের রূপালি রঙ আর মাঠ ভরা হলুদ সরিষা ফুলের রঙের মূর্চ্ছনায় অনন্য এখন প্রকৃতি। যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ বর্ণের ফুল। শীতের শুভ্রতায় প্রাণের স্পন্দন নিয়ে এসেছে এই সরিষা ফুল। পড়ন্ত বিকেলে সোনালী রৌদ্দুরে রঙেগন্ধে মোহিত এখন সরিষা ক্ষেত। শীতের মধ্যে গ্রামগুলো সেজেছে হলুদ বর্ণের এক মায়াবি সাজে। চারিদিকের অবারিত সরিষা ক্ষেত, শীতের গ্রাম বাংলার প্রকৃত সৌন্দর্য রূপ ফুটে উঠেছে। দূর থেকে মনে হয় শ্যামল মাঠে দিগন্ত জোড়া বিছানো যেন হলুদ রাঙা কার্পেট। শীতের মৃদু বাতাসের আলিঙ্গনে হলুদের বুকে ঢেউ খেলে যায়। সরিষার ফুলেফুলে মৌমাছির আনন্দ বিচরণ, গুণগুণ গান, প্রজাপতির দুরন্তপনা ও ছোট ছোট পাখিদের কিচিরমিচির শোভা পাচ্ছে। ফুলের মুহুমুহু গন্ধ, আবেশসহ সব মিলিয়ে রূপে গন্ধে এখন স্মিগ্ধ নির্মল বায়ু। এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমিদের আনাগোনাও বেড়েছে। দিন ১৫ পরেই এই দৃশ্য ভাটা পড়বে। ফুলের কোলে জন্ম নেবে সরিষার ছড়া।
শেরপুর কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জেলায় বিগত বছরের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে এই বছরে ১২ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এই বছরে জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮হাজার ৯০৭ হেক্টর জমিতে। কৃষি বিভাগের হিসাবের বাইরে আরও বেশী জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে বলে চাষিদের দাবি। ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮২ হেক্টর, ২০২০ সালে ৭ হাজার ২১৫ হেক্টর , ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়। জেলার চরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশী সরিষার আবাদ হয়েছে। আর পাঁচ উপজেলার মধ্যে নকলাতে সর্বাধিক পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে এই তেল বীজের উৎপাদন হয়েছে বলে জানা গেছে।

সরিষা উৎপাদনে সময় প্রয়োজন ৭০/৮০ দিন। জেলার কৃষি বিভাগ বলছে, রোপা আমন ধান কাটার পর বোরো লাগাতে চাষির জমি খালি রাখা সম্ভব হয় ৫০ থেকে ৬০ দিন। সরিষা চাষের জন্য পর্যাপ্ত সময় পেতে কৃষি বিভাগ অনেক কৃষককে স্বপ্ন জাতের আগাম রোপা আমন লাগাতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে অন্তত ২০ দিন আগে আমন কাটতে পেরেছে চাষি। এতে ওই মাঠ থেকে সরিষা উঠিয়েই সাথে সাথে বোরো লাগাতে চাষিরা সঠিক সময় পাবে। এখন কৃষিতে মজুরের ব্যবহার কমেছে বেড়েছে যন্ত্রের ব্যবহার। ফলে সময় ও শ্রম কম লাগে। এতে দুই ফসল উঠানো ও লাগানোর সময় সমন্বয় সম্ভব হয়েছে। এ জন্য বিস্তর জমিতে লাভ জনক এই রবি শস্য উৎপাদনে কৃষক আগ্রহী হয়েছে।
তার উপর আবার সরকার উৎপাদন বাড়াতে জেলার অন্তত ৩০ হাজার কৃষককে সরিষা উৎপাদনে উন্নত উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪, বারি-১৭,বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের বীজ-সার প্রণোদনা দিয়েছে। চাষির মাঠে কৃষি বিভাগের লোকজনের সরব উপস্থিতির ফলে চাষিরা ব্যাপক উদ্দীপনা পেয়েছে। চাষিরা জানিয়েছেন, আমন উঠানোর পরপর বোরো লাগানোর মাঝখানের সময়টুকুতে সরিষা লাগিয়ে লাভের স্বপ্ন দেখছেন। আবহাওয়া অনুকূল ও কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় চাষিরা সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন।
এ ব্যাপারে শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশে ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য খাদ্য সংকট হতে পারে-এই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎপাদন বাড়াতে এই ইঞ্চি জমিও খালি না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ অনুয়ায়ি জেলার চাষি, প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠে। এই ফলশ্রুতি ও সরকারি প্রণোদনার কারণে সরিষাতে এমন সাফল্য এসেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে দেশের চাষিরা সরিষা ঘরে উঠাতে পারলে তেলের বিশাল সংকট থেকে দেশ অনেক রক্ষা পাবে। বাঁচবে তেল আমদানির বিশাল বৈদেশিক মুদ্রা।