ads

সোমবার , ৮ আগস্ট ২০২২ | ৬ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনপ্রাপ্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  1. ENGLISH
  2. অনিয়ম-দুর্নীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আমাদের ব্লগ
  6. ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  7. ইসলাম
  8. উন্নয়ন-অগ্রগতি
  9. এক্সক্লুসিভ
  10. কৃষি ও কৃষক
  11. ক্রাইম
  12. খেলাধুলা
  13. খেলার খবর
  14. চাকরির খবর
  15. জাতীয় সংবাদ

আমার মা : শেখ হাসিনা এমপি

শ্যামলবাংলা ডেস্ক
আগস্ট ৮, ২০২২ ৬:১৩ অপরাহ্ণ

“বুকে পাথর চেপে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে
হাসিমুখে সকল সমস্যা
সমাধানে ব্যস্ত হয়ে উঠা,
এইতো আমার মা- আমার মা রেণু।”
(শেখ রেহানা, লন্ডন, ৮ আগস্ট ২০০৮)

Shamol Bangla Ads

রেণু! ফুলের রেণুর মতোই গায়ের রং। মাথায় ঘন-কালো একরাশ চুল। অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারিণী আমার মায়ের জীবনপ্রদীপ মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে নিভে গেল। আমার আব্বার সঙ্গে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। কিন্তু কেন? কেন? কেন? আমরা দুুই বোন- রেহানা এবং আমি- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি আজও। কিন্তু কে আমাদের দেবে এর উত্তর?
আমার আব্বা যেহেতু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, রাষ্ট্রপতি ছিলেন, আমাদের বাসায় আত্মীয়স্বজন ছাড়াও দলের লোকজন, সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল অহরহ। আমার মা সকলকেই আপ্যায়ন করাতেন, কেউ খালি মুখে ফিরে যেতেন না। আমার মা সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। দেশের ফার্স্ট লেডি ছিলেন তিনি। এ নিয়ে তিনি কোনোদিন কোনো রকম গর্ব দেখাননি বা এটা নিয়ে তাঁর কোনো অহমিকা ছিল না। তিনি ছিলেন কারও আপা, কারও ভাবি, চাচি, মামি, খালা, ফুপু- যে যেমন সম্পর্কের, তেমনি তাঁকে সম্বোধন করতেন এবং হাসিমুখে সবই মেনে নিতেন।
গরিব আত্মীয়স্বজন বা দলের নেতা-কর্মীদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, বিয়ের ব্যবস্থা, রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা- এসবই তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতেন। ১৯৫৪ সালে মিন্টো রোডের সরকারি বাড়ি থেকে চলে এসে আমরা পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার লেনের একটা বাড়িতে থাকতাম। তখন রেহানা এবং রাসেলের জš§ হয়নি। আমরা তখন তিন ভাইবোন- ছোট দুই ভাই কামাল, জামাল আর আমি। তখনও দেখেছি ওই বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগের বহু নেতার বিয়ের আয়োজন মা করে দিতেন। বিয়ের সাজে বরযাত্রী সাজিয়ে দিতেন। এমনকি বউবরণ করা অথবা কনে দেখাÑ সব দায়িত্ব একান্ত আপনজনের মতো আমার মা পালন করতেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ছুটি হতো অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না হতো আমাদের আত্মীয়স্বজন যারা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন তাঁরা বন্ধুদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হতেন, খাবার খেয়ে যেতেন। আমার মা হাসিমুখে সকলকে আপ্যায়ন করতেন।

আমার আব্বা যখন কারাগারে বন্দি থাকতেন, আমাদের চরম দুঃসময় শুরু হতো। কিন্তু আমার মা কখনই ভেঙে পড়তেন না। কখনও হতাশ হতে দেখিনি তাঁর চোখেমুখে। সবকিছু নীরবে সহ্য করতেন। আব্বার মামলা-মোকদ্দমা, দলের কাজ, নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া, অনেক নেতার বাড়িতে বাজারের টাকা পৌঁছে দেওয়া- সবই করতেন।
আত্মীয়স্বজন অথবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন, প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করাতেন, নিজে তাঁদের হাসপাতালে দেখতে যেতেন। হাতে টাকা না থাকলে নিজের গহনা বিক্রি করে তিনি দল চালাতেন, ছাত্রদের সাহায্য করতেন। আব্বার মামলা-মোকদ্দমা, আন্দোলন-সংগ্রাম সবই তিনি পর্দার আড়ালে থেকেই করেছেন।
আমার নানা ও নানি মারা যাবার পর তাঁদের সব সম্পত্তি আমার মায়ের দাদা খালা ও মাকে লিখে দিয়ে যান। আমার দাদাই দেখাশোনা করতেন মায়ের বিশাল সম্পত্তি। সেখান থেকে যা টাকা পয়সা আসতো তা দিয়ে চলতে চেষ্টা করতেন। সেই সঙ্গে আব্বার অনেক বন্ধু-বান্ধব সহযোগিতা করতেন। আমার দাদাও বাড়ি থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি পাঠাতেন। মা কখনও নিজের জন্য কিছু ব্যয় করতেন না।

Shamol Bangla Ads

আব্বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতেন। মা সে বিষয়টা খুব ভালোভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে উপলব্ধি করতেন। তাই তিনি চাইতেন আব্বা যেন তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন, একনিষ্ঠভাবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন। সব সময় পাশে থেকে তিনি প্রেরণা দিয়েছেন আর সংসারে সকল বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
আব্বার কাপড়-চোপড়, জুতো-স্যান্ডেল যা যা প্রয়োজন সবকিছু মা নিজের হাতে গোছাতেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন। আমার আব্বাকে কখনও কোনো প্রয়োজনে বিরক্ত করতেন না, বরং এ কথা বলতেন: সংসারের চিন্তা তোমার করতে হবে না, ওটা আমি সামলাব। তুমি দেশের জন্য কাজ করছো, দেশের মানুষের জন্য কাজ করছো- তাই করো। আব্বা চাইতেন বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে উন্নত জীবন পাবে। তাই স্বাধীনতা একান্তভাবে প্রয়োজন। আমার মা এই আদর্শ ধারণ করেছিলেন। আব্বা যেমন এদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন, মা-ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন।

আমার মা ছোটবেলা তাঁর বাবা-মাকে হারান। ছোট্ট রেণুকে তাঁর দাদা বিয়ে দেন। এরপর থেকে আমার দাদির কাছেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ছোট্ট রেণু যখন তাঁর বাবার জন্য কান্নাকাটি করতো, তখন আমার দাদি বলতেন- আমি তোর বাবা। তাই দাদিকেই তিনি ‘বাপ’ বলে ডাকতেন। সব বাচ্চাই কিন্তু নিজের আপনজনকে ডাকার জন্য তারা একটা নাম ঠিক করে নেয়। তাই দাদিকে ‘বাপ’ বলেই আমার মা ডাকতেন। মা বই পড়তে ও গান শুনতে খুব ভালবাসতেন।
আমার আব্বা জেলের বাইরে থাকলে বারট্রান্ড রাসেলের বই পড়ে বাংলা তরজমা করে আমার মাকে শোনাতেন। তাই তো আমার ছোট ভাইটি জš§াবার পর মা তার নাম রেখেছিলেন ‘রাসেল’। আমি, কামাল, জামাল টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করি আর রেহানা ও রাসেল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করে। আমরা পাঁচটা ভাইবোন যখন জন্মগ্রহণ করি আমার আব্বা কখনই আমার মায়ের পাশে ছিলেন না। সব সময় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তাই বলে আমার মা কখনও এ নিয়ে অভিযোগ করেননি বা অভিমানও করেননি। আমার আব্বার আদর্শকে তিনি এমনভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁর সকল কাজে তিনি সহযোগিতা করতেন।
আমরা যদি আমার মায়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিকটা দেখি তখন দেখতে পাই সেখানেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে টুঙ্গিপাড়ায় সকলে এক সঙ্গে কাজ করে। আমার মা-ও সে নির্বাচনের সময় রান্নাবান্না করা, মানুষকে আপ্যায়ন করা ইত্যাদি নানা কাজে আমার দাদিকে সহযোগিতা করেছেন। আব্বা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আমার মা ১৯৫৪ সালে ঢাকায় আসলেন এক বুক আশা নিয়ে সংসার করবেন বলে। আব্বা মন্ত্রী হলেন। আমরা মিন্টো রোডের বাড়িতে উঠলাম। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দিল। আমার আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আমার মায়ের স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমরা নাজিরা বাজারের বাসায় উঠলাম।

১৯৫৫ সালে আব্বা পাকিস্তান ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। আব্বা আবার মন্ত্রী হলেন। ১৫ নম্বর আব্দুল গনি রোডের মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত বাসায় আমরা উঠলাম। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন আমার আব্বা। আমার মা কিন্তু কোনো অভিযোগ বা অভিমান করেননি। হাসিমুখেই আমার আব্বার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন। আমরা সেগুনবাগিচার একটি বাসায় উঠলাম। নতুন করে সংসার সাজালেন মা। আব্বাকে টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর মিলিটারি ডিক্টেটর আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা সত্ত্বেও নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তিনি।
১১ অক্টোবর আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তিন দিনের নোটিস দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। সিদ্ধেশ্বরীর একটা ছোট্ট বাড়ি, যেখানে কোনো রাস্তাঘাটও ছিল না, বাড়িটাও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। অসম্পূর্ণ সেই বাড়ির দুটি কামরায় আমরা উঠি। এরপর সেগুনবাগিচায় ৭৬ নাম্বার বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে আমাদের জায়গা হয়। ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের রায়ে আব্বা মুক্তি পান। কিন্তু রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ঢাকার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আব্বা তখন আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে একটা চাকরি নিলেন। আমার মা সে সময় ধানমণ্ডির বাড়ির কাজ শুরু করেন। দুটি বেডরুম আর একটা বসার ঘর তৈরি করেই আমাদের এই বাড়িতে নিয়ে আসেন।

আমার আব্বার কর্মজীবনটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন আমার মা। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আব্বা যে কাজ করছেন, সংগ্রাম করছেনÑ মা সেটা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেন। আব্বার পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন। আব্বা যে একটা মহৎ কাজ করছেন সে বিশ্বাস সব সময় মা পোষণ করতেন। ৬-দফা দাবি পেশের পর যখন ১৯৬৬ সালের মে মাসে আব্বা গ্রেফতার হন, তারপর থেকে সকল সংগ্রাম আমার মা-ই করে গেছেন। ৬ জুনের হরতাল থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামে আমার মায়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মিলে ৬-দফার পরিবর্তে ৮-দফা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আমার মা এর ঘোর বিরোধিতা করেন। তাঁর কথা ছিল যে, আব্বা যেহেতু ৬-দফা দিয়ে গেছেন, তাই ৬-দফা ৬-দফাই থাকবে।

একটা কঠিন সিদ্ধান্ত আমার মা দিয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে আমার আব্বাকে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করা হয়। তখন আমার মা সফলভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন।
গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে গোপনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আমার মা বৈঠক করতেন, নির্দেশনা দিতেন এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সবরকম সহযোগিতা দিতেন।
আন্দোলন-সংগ্রামে সমগ্র বাংলা যখন উত্তাল, তখন আইয়ুব খানের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে বৈঠকে বসার। আব্বাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে সেই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। আমার মা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে যাওয়ার ঘোর বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি ছিল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে এবং কেবল মুক্ত মানুষ হিসেবেই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন।
তাঁর এই সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ক্ষুব্ধ হন। আমার মাকে তাঁরা এমন কথাও বলেন যে, “আপনি এটা কী করলেন? আপনি তো বিধবা হবেন।” আমার মা সে কথায় বিচলিত হননি। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং সংগ্রাম যাতে আরও বেগবান হয় তার ব্যবস্থা নেন। এরপর গণঅভ্যুত্থান ঘটে। আইয়ুব খান মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি মামলা তুলে নেওয়া হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি আমার আব্বাসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

জাতীয় জীবনে এ সিদ্ধান্ত যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা আজ চিন্তা করলে অনুধাবন করা যায়। এরপর আইয়ুব খানের পতন ঘটে। পাকিস্তানের আরেক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়। সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালির হাতে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না। শুরু করে ষড়যন্ত্র। তখন সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন আমার আব্বা। ৭ মার্চ ১৯৭১। রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় আব্বা ভাষণ দেবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন। অনেক মানুষই অনেক পরামর্শ দিতে থাকেন আব্বা কী বলবেন বা কী বলা উচিত। আমার মা আব্বাকে বলেন যে, ‘তোমার কারও কথা শুনতে হবে না, তোমার মনে যে কথা আছে তুমি সেই কথাই বলবে।’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আমার আব্বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন, যা সকল জেলা, মহকুমা, ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পৌঁছে যায়। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবেÑ সে বার্তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে চলে যায়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই রাতেই আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কারাগারে। আমার মা গ্রেফতার হন। সঙ্গে জামাল, রেহানা, রাসেল এবং আমি। আমার মা কখনও ভেঙে পড়েননি। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করবে, বিজয় অর্জন করবে। আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
আন্তর্জাতিক চাপে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রায় ৯৬ হাজার সেনা সদস্যসহ যারা স্বাধীন বাংলাদেশে আটকা পড়ে, তাদের স্বার্থে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় আমার আব্বাকে মুক্তি দিতে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আমার মা ফিরে পান তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে। সেই দিন দেখেছি মায়ের আবেগ আর ভালোবাসা। তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। সকল বাঁধ ভেঙে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমার আব্বার বুকের ওপর।

১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নতুন সংগ্রাম শুরু করেন আমার আব্বা। আমার মা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত মা-বোনদের পাশে দাঁড়ান তাঁদের চিকিৎসা, সামাজিকভাবে তাঁদের পুনর্বাসন করার কাজে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাঁদের জীবন গড়ে দিয়েছেন। আমার আব্বা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এই সময়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর যাত্রা শুরু করে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যান এবং স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা এনে দেন।
আব্বা ঘুণেধরা সমাজ ভেঙে একটি নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রশাসনিক অবকাঠামো ভেঙে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষের ক্ষমতায়ন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে বাংলার মানুষকে মুক্তি দিয়ে একটি উন্নত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে চলার পথ দেখিয়ে ছিলেন।

আমার বাবার চলার পথে আমার মায়ের যে আত্মত্যাগ, সাহসী ভূমিকা তা আমাদের দেশের প্রত্যেক নারীর জীবনে প্রেরণা হয়ে থাকবে। স্বামীর আদর্শকে বুকে ধারণ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কীভাবে পাশে থেকে প্রেরণা দেওয়া যায়, শক্তি-সাহস দেওয়া যায় তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমার মা। ব্যক্তিগত জীবনে সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি আমার বাবার পাশে থেকেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেইমান মুনাফিকের দল আমার আব্বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে মানুষের সকল আশা-আকাক্সক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ সব ধ্বংস করে দেয়।
আমার মা জীবনের সকল সময় আমার বাবার সংগ্রামের সঙ্গী ছিলেন। ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে তিনিও জীবনটা দিয়ে গেলেন। ঘাতকদের কাছে তিনি জীবন ভিক্ষা চাননি বরং সাহসের সঙ্গে বলেছিলেন: তোমরা তাঁকে যখন হত্যা করেছ, আমাকেও হত্যা করো।
ঘাতকের হাতের অস্ত্র গর্জে ওঠে। ৩২ নম্বর বাড়ির মেঝেতে আমার মা লুটিয়ে পড়েন। এরপর একে একে সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়, সবার শেষে ছোট্ট রাসেলকে হত্যা করে। আমার বাবার সমগ্র জীবনের সাথি আমার মা মরণেও তাঁর সাথি হলেন।

লেখক : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

error: কপি হবে না!