বছর ঘুরে ফের ফিরে এসেছে মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে সব ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া। ঈদুল আজহা হাজির হয় ত্যাগের মাহাত্ম্য নিয়ে। নিজ স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে অন্যের কল্যাণই শিক্ষা দেয় এই ঈদ। বছর ঘুরে আবার আমাদের জীবনে এসেছে সেই ঈদ। সব ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মিলিত হওয়ার দিন।

বর্তমান বিশ্বে যে ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা থেকে পরিত্রাণ ঘটাতে পারে একমাত্র ঈদুল আজহার দীক্ষাই। কারণ ঈদুল আজহা একজন মানুষকে নমনীয় হতে শেখায়। শেখায় কীভাবে ভেতরের পশুকে দমন করে সুস্থ চিন্তা এবং কর্মযজ্ঞে ফিরে আসা যায়। চারিদিকে যে হানাহানি, যে অসত্যের দাপট আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার ডামাডোল তা থেকে নিজেকে বা গোষ্ঠীকে ফিরিয়ে আনতে পারে কোরবানির আত্মত্যাগ।
আমরা জানি, মহান আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নের মাধ্যমে তার প্রিয় নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আনুগত্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দিতে। ঘুম ভেঙে গেলে তিনি ভেবে দেখলেন, তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-ই তার সবচেয়ে প্রিয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আল্লাহর খুশির জন্য তিনি তার পুত্রকেই কোরবানি করে দিবেন। বাবা হয়ে সন্তানকে নিজ হাতে কোরবানি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু তিনি তা নিতে পেরেছিলেন। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টিই ছিল তার কাছে প্রধান। তাই নিজের ছেলেকে কোরবানি দেয়ার মতো কঠিন পরীক্ষায় তিনি দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগোতে পিছপা হননি। কিন্তু আল্লহর অসীম রহমতে ছেলের জায়গায় একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায় এবং সেই থেকে পশু কোরবানি করা আমাদের জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে এরও নির্দিষ্ট কিছু শর্ত রয়েছে। সেই শর্তের অধীনে যারা, শুধু তাদের জন্যই কোরবানি করা ওয়াজিব। অনেকে করে, তাই আমিও করব- এমন মনোভাবের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তা আল্লাহর দরবারে কবুলও হবে না। মনে রাখতে হবে, পশু কোরবানি মানে কোনো প্রতিযোগিতা নয়। আল্লাহ দেখবেন বান্দার ত্যাগ ও আনুগত্য। কত বড় পশু ছিল বা কত মোটাতাজা এটি তার কাছে মুখ্য কোনো বিষয়ই নয়।

পবিত্র ঈদুল আজহার উদ্দেশ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য নিজের সব ধরনের রিপুকে দমনে প্রস্তুত থাকা। সেই উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি একটি প্রতীকী উদ্যোগ। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা আমাদের শুদ্ধ আত্মাকে বিনষ্ট করে দেয়। এর থেকে উত্তরণের জন্য সৎ পথে উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে কেনা পশু কোরবানি দেয়াই একমাত্র পন্থা। কিন্তু আমরা এর চর্চা সমাজে দেখি না। কোরবানির অন্তর্নিহিত বক্তব্য হূদয়ে ধারণ না করে আমরা লোক দেখানো, লোকের প্রশংসা পাওয়ার জন্য নানা কার্যক্রমই করে যাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে ভোগবিলাসী জীবনই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা কারো জন্যই ভালো নয়। না ব্যক্তির জন্য, না সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তা কল্যাণকর। এ ধরনের চর্চা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। সমাজে শ্রেণি বিভেদ তৈরি করে। বৈষম্য বাড়ায়।
আমাদের দেশে বহু বিপদগ্রস্ত মানুষ রয়েছে। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় অনেক মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়েছেন। সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাই হতে পারত কল্যাণময় আত্মত্যাগ। তবে আমরা কম লোকই এভাবে ভাবি।
ঈদুল আজহার দিন সারাদেশে পশু জবাই হবে। সেইসব পশুর বর্জ্য যাতে দ্রুত অপসারণ করা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে পরিবেশ দূষণসহ নাগরিকদের চলাফেরায় নানা সমস্যা তৈরি করবে যা ঠিক হবে না।
বিশ্ব শান্তির জন্য কোরবানির আদর্শকে ধারণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই সবার ঈদযাত্রা নিরাপদ হোক, কোরবানীর মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করুক এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক বিশ্ব-ঈদের মাহেন্দ্রক্ষণে এই প্রত্যাশা আমাদের। ঈদ মোবারক।