সম্প্রতি গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ এর ৮০ ফুটের অফিশিয়াল আইম্যাক্স স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়েছে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় এবং অস্কারজয়ী প্রযোজক ইলান জিরার্ডের প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নোনা জলের কাব্য’। বাংলাদেশের পটুয়াখালীতে ম্যানগ্রোভ বনসমৃদ্ধ সমুদ্র তীরের গ্রামীণ পরিবেশেই চলচ্চিত্রের অধিকাংশ চিত্রধারণ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সেখানকার এক প্রান্তিক জেলেপাড়ার যাপিত-জীবন ও তাদের সমস্যার উপাখ্যানই এই চলচ্চিত্রের উপজীব্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবজনিত সমস্যার সরাসরি ভুক্তভোগী ঐ প্রান্তিক জেলেরা। ছোট আকারের শ্যালো-ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি নৌকাই তাদের মাছ ধরার একমাত্র অবলম্বন। কালের পরিক্রমায় বড় আকারের যন্ত্রচালিত উন্নতমানের ট্রলার চলে আসায় প্রান্তিক এই জেলেদের প্রতিযোগিতা এমনিতেই আরো কঠিন হয়ে পরেছে। তার উপর প্রজনন মৌসুমে সরকার নির্ধারিত ফিশিং-ব্যানগুলো যেন তাদের জন্য মরার উপর খারার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের জীবনচক্রেও পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসজনিত দুর্ভোগে জেলে-জীবনে একেবারে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। যেহেতু মৎস্য আহরণই ঐ অঞ্চলের জেলেদের প্রধান উপজীবিকা, তাই ২ মাসব্যাপী আরোপিত ফিশিং ব্যানের সময়টায় তারা পুরোপুরিই বেকার হয়ে পড়েন। আর এই দুর্ভোগের সময়টাতেই কুসংস্কার ডানা বাঁধে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ঐসব জেলেপাড়ায়।
শহুরে প্রগতিশীল একজন ভাস্করের আগমন এবং তার ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগকেই সাগরে মাছ না পাওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করেন কিছুসংখ্যক জেলে। বিষয়টিকে তারা আল্লাহর গজব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। আবার সজ্ঞানে কেউ কেউ এর সাথে একাত্মতা পোষণ না করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের অসহায়ত্বও চলচ্চিত্রে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। হঠাৎই আগত ঐ ভাস্করের আগমন এবং তাকে ঘিরে গ্রামবাসীর জল্পনা-কল্পনা, ভালো-লাগা ও শঙ্কা এবং পরিশেষে সংঘাত – এই নিয়েই এগিয়েছে চলচ্চিত্রের গল্প।
পুরো চিত্রনাট্যে কোনো খলনায়ক যদিওবা নেই কিন্তু সচেতনভাবেই এখানে জেলদের এহেন পরিস্থিতির জন্য প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে সমাজের কর্তাশ্রেণির প্রতি। ‘আমগোরে বিক্রি কইরা বিদেশ থেইকা সম্মান নিয়া আইবেন?’—চিত্রনাট্যে ভাস্করকে এমনটাই জিজ্ঞেস করছিলেন চলচ্চিত্রের এক জেলে ভাই। বিষয়টি স্পষ্টভাবেই প্রতিকায়িত করছে সেই শ্রেণিকে যারা কেবলই ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে প্রচার করছে আক্রান্তদের অসহায়ত্বকে।
কিন্তু সংগ্রামী সেই মানুষগুলো মোটেই এর জন্য দায়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তারা কেবলই আক্রান্ত, পরিস্থিতির শিকার। তাদের জীবনও একসময় স্থিতিশীল ছিল। তারাও যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করতো। তাদের জীবনেও আনন্দের উপলক্ষ্য ছিল। কিন্তু, এখন তারাই অস্তিত্ব সংকটে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াল প্রভাব ছুঁয়ে গিয়েছে তরুণ নির্মাতা সুমিতকে। ঐ নির্দোষ মানুষগুলোর অসহায়ত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে বড় পর্দায় গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বলে জানিয়েছেন সুমিত।
কপ-২৬ এর ব্লু-জোনে বিশ্বের ক্ষমতার রাষ্ট্রনায়ক ও বড় সব নীতিনির্ধারকদের সামনে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর সত্যিকারের দৃশ্যপট তুলে ধরতে পারাকে একটি বড় মাইলফলক হিসেবেই দেখছেন সুমিত। শুধু বিনোদনের উপলক্ষ্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের উৎসরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে সামনে থেকে একটি দৃঢ় বার্তা দেয়া কিংবা শহরের নির্লিপ্ত তরুণদের মনে অসহায় ঐ মানুষগুলোর জন্য সূক্ষ্ম-সংবেদনশীলতা তৈরীর মাধ্যম হিসেবেই ‘নোনা জলের কাব্য’কে ব্যবহার করতে চান সুমিত। শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নামকরা প্রেক্ষাগৃহে একযোগে মুক্তি পেতে যাচ্ছে চলচ্চিত্রটি।