দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় একটা দিক আছে। শাস্ত্রীয় গ্রন্থ থেকে তুলে দিই : ‘মহিষাসুর দেবগণকে স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া স্বর্গরাজ্য অধিকার করেন। দেবগণ বিপন্ন হইয়া ব্রহ্মার শরণ লন। ব্রহ্মা দেবতাদিগকে সঙ্গে করিয়া মহাদেবের নিকট উপস্থিত হন এবং মহেশ্বরের নিকট দেবতাদিগের দুর্দশা বর্ণন করেন। মহাদেব ক্রুদ্ধ হইলেন; তাঁহার বদন হইতে এক তেজ নির্গত হইল। ব্রহ্মাও অন্যান্য দেবগণের মুখ হইতে এক তেজোরাশি নির্গত হইল। সমবেত তেজোরাশি এক রমণী মূর্তি পরিগ্রহ করিল। দেবতাগণ স্ব স্ব আয়ুধ এই রমণীকে প্রদান করেন। এই দেবীই মহিষাসুরকে তিনবার নিধন করেন। প্রথমবার উগ্রচণ্ডারূপে, দ্বিতীয়বার ভদ্রকালীরূপে ও তৃতীয়বার দুর্গারূপে।’- বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে দুর্গার আবির্ভাবের কথা নানা ভাষায় বর্ণনা করা হলেও মূল বক্তব্য এই। এই বক্তব্য অনুসারে কিন্তু দুর্গা ঐক্যের প্রতীক বা দুর্গা ঐক্যবদ্ধ মিলিত শক্তি। অন্যভাবে বলা যায়, ঐক্যের সাধনাই দুর্গার সাধনা। উৎসবও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। সেদিক থেকে দুর্গাপূজার আর এক নামই তো উৎসব!
অবাঙালি হিন্দুদের কাছে রাম যতটা পূজিত, বাঙালি হিন্দুদের কাছে ততটা নন। কিন্তু বাঙালিরাই রামের সেই অকালবোধনকে অনেক বড় করে পালন করে। তারা অবশ্য সময়-পরম্পরায় দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন করে ফেলেছে। ধর্মের শাঁসটুকু রেখেই একে নিয়ে এসেছে ধর্মের ঊর্ধ্বে। তাই দুর্গা ‘পূজা’ থেকে আজ ‘উৎসবে’ পরিণত। ইতিহাসে দেখা যায়, দুর্গাপূজাটা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে। লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মতো এর ব্যাপকতা ছিল না অর্থনৈতিক কারণে। দুর্গাপূজা করতে অনেক আয়োজন করতে হয়। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে এ পূজা করা সম্ভব নয়। যাদের ঘরে চাল বাড়ন্ত, চার-পাঁচ দিনের পূজা তাদের চলবে কেন? অনেক দেব-দেবীর একত্র অধিষ্ঠান বলে এখানে পূজার সংখ্যাও বেশি। মহাদেব-লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের পাশে পূজা পায় কলা-বউও। এমনকি মহিষাসুরকেও পূজা দিতে হয় (মহিষাসুর পরাজয়ের আগে দেবীর বর চেয়ে নিয়েছিল এই বলে যে, দুর্গার সঙ্গে মানুষ তাকেও যেন পূজা দেয়)। ফলে এই মহা-আয়োজন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
ব্রিটিশ আমলে প্রতি গ্রামের দু-তিন ঘর সম্পন্ন পরিবার এই পূজা করত। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষরাও আনন্দ পেয়েছে বটে, তবে সেটা প্রসাদ-পাওয়ার আনন্দ; বাদ্য-বাজনা শোনার আনন্দ- দূর থেকে দেখার আনন্দ! কামার-কুমোরেরা এটা-ওটা বানিয়েছে বিক্রি করার জন্য। সম্পন্ন পরিবারের সন্তানরা অর্থনৈতিক কারণে নতুন যুগের হাতছানিতে এগিয়ে যায়। তারা ব্যবসা বা লেখাপড়াতে নিবিষ্ট হয়। সেই সূত্রে বাড়ির বাইরে, অন্যত্র অবস্থান বা প্রতিষ্ঠা ঘটে তাদের।
দেখা গেছে, পারিবারিকভাবে পূজার সময় সেই সব পরিবারের সন্তানরা বাড়িতে একত্রিত হয়। এ থেকেই ঐক্য ধরে রাখে পরিবারটি। অবশ্য একই বড় পরিবারে একাধিক পূজাও হয়েছে, ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক একটা প্রতিযোগিতার ভাবও গড়ে ওঠে তাদের। আবার আনুষ্ঠানিকভাবে ভিন্ন সংসার করেছে এমন ভাইয়েরা যৌথভাবে দুর্গাপূজা করেছে, এমন উদাহরণও বিরল নয়। যেভাবেই দেখা যাক না কেন, দুর্গাপূজা পরিবার বা সংসারের সদস্যদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনই করে। সাধারণ অসচ্ছল হিন্দুরা এর মূল আয়োজন থেকে দূরে থেকেছে। পূজা করার সংগতি সাধারণ হিন্দুরা রাখত না; সম্পন্নদের ভয়ে সে সাহসও হারিয়েছিল বোধ হয়।
কিন্তু অফিস, স্কুল, কলেজ দীর্ঘদিন ছুটি থাকত পূজা উপলক্ষে। সে কারণে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসত সাধারণ মানুষ। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিভিন্ন বাড়ির নারী ও শিশুরা যে বেড়াতে যেত বা নাইয়র করত আর পূজার সময়ে পূজা-বাড়িতে ভিড় করে রাখত, একশ বছর আগেও এ চিত্র ছিল স্বাভাবিক। দুর্গাপূজা তারা না করতে পারলেও এই পূজা থেকে তারা নিজেদের বিযুক্ত ভাবত না কখনও। উৎসবের আবহ থাকত সবার মনেই।
দেশভাগের কারণে হিন্দু পরিবারের পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন করা- ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়! পরেও সাধারণ হিন্দুদের অনেকে বাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকে। যেসব সম্পন্ন পরিবার এ দেশে থেকে যায়, তাদের বেশিরভাগ নিজেদের নিরাপত্তা এবং শাসক-সম্প্রদায়ের নিপীড়নের কারণে পূজা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় দুরু দুরু বক্ষের অসচ্ছল কিন্তু উদ্যোগীদের আগ্রহে বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে এবং তা আর শুধু সম্পন্নদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আগে অসচ্ছলদের পক্ষে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হতো না। এরপর সম্মিলিতভাবে পূজার আয়োজনও তারা করে। পশ্চিমবঙ্গেও পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষের আগ্রহ এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ফলে বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রসার ঘটে। এভাবেই যে পূজা এক সময় কোনো পরিবারের ঐক্য স্থাপনে ভূমিকা রেখেছে, সেই পূজা সমাজে সম্প্রীতি ও বন্ধন দৃঢ়তর করতে ভূমিকা রাখে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।