গৃহকর্তাকেও গ্রেফতারসহ দম্পতির ফাঁসি চান স্বজনরাসহ সচেতন মহল
স্টাফ রিপোর্টার ॥ শেরপুরের শ্রীবরদীতে বর্বরোচিত নির্যাতনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার ২৭ দিন পর মারা যাওয়া সেই শিশু গৃহকর্মী সাদিয়া আক্তার ফেলির (১০) চাঞ্চল্যকর মামলাটি এখন হত্যা মামলায় মোড় নিয়েছে। ২৬ অক্টোবর সোমবার এ সংক্রান্তে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদন আদালতের নথিতে শামিল করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত সূত্র জানিয়েছে, পূজার ছুটি থাকায় মঙ্গলবার তা আদালতের গোচরীভূত করা হবে।
এদিকে নির্যাতনে ওই গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় শ্রীবরদীসহ খোদ জেলায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সাদিয়ার স্বজনরাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতা ও সচেতন মহলের অনেকেই ওই মামলায় পাষ- গৃহকর্ত্রী রুমানা জামান ঝুমুরের স্বামী, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব শাকিলকেও গ্রেফতারসহ ওই দম্পতির ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে সমালোচনার ঝড়।
সোমবার দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শ্রীবরদী থানার এসআই সাইফুল ইসলাম শ্যামলবাংলা২৪ডটকমকে জানান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে সাদিয়ার লাশ নিয়ে আসার পর শনিবার রাতে শ্রীবরদী শহরের মুন্সীপাড়া এলাকায় দাফন করা হয়। এজন্য রবিবার বিকেলে নির্যাতিত সাদিয়ার মৃত্যুর বিষয়ে তার ডেথ সার্টিফিকেটসহ আদালতে সংশ্লিষ্ট আইনে হত্যার ধারা সংযোজনের আবেদন করা হয়েছে। আর নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী ঝুমুরকে রিমা-ে নেওয়ার কোন পদক্ষেপ আছে কি না, সে বিষয়ে তিনি বলেন, আপাতত নেই। প্রয়োজন হলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে নেওয়া হবে।
অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তার ওই আবেদনের বিষয়টি আদালতের গোচরীভূত হয়েছে কি না বা আমলে নেওয়া হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কোর্ট পরিদর্শক খন্দকার শহীদুল হক জানান, তদন্ত কর্মকর্তার প্রার্থীত আবেদনটি আদালতের নথিতে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি ছুটির কারণে তা মঙ্গলবার আদালতের গোচরীভূত করা হবে এবং সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আদেশও হতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি এডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুলু শ্যামলবাংলা২৪ডটকমকে বলেন, মামলাটি প্রথমে দহনকারী, ক্ষয়কারী বা বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা কোন শিশু বা নারীর শরীরের কোন অঙ্গ, গ্রন্থী বা কোন অংশ বিকৃত বা নষ্ট করার অভিযোগের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (২) খ ধারায় রেকর্ড হয়েছিল। এখন মামলার সেই ভিকটিম শিশু সাদিয়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় সঙ্গত কারণে একই আইনের ৪ (১) ধারা সংযোজনের জন্য ওই আবেদন করা হয়েছে। আর এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-সহ অনুর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকা অর্থদ-। তবে এ বিষয়ে জেলা মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র ফৌজদারী আইনজীবী প্রদীপ দে কৃষ্ণ বলেন, মামলাটি রেকর্ডের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা অসাবধানতা ছিল। কারণ সংশ্লিষ্ট আইনের ৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, অনুরূপভাবে যদি কোন ব্যক্তি কোন শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান, বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন তাহলে একই ধারার অপরাধ বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই মামলাটি ৪ (১) ধারায় রেকর্ড করা যেতো এবং তাহলে নতুন করে ওই ধারা সংযোজনের বা আবেদনের প্রয়োজন ছিল না। শুধুমাত্র ভিকটিমের মৃত্যুর বিষয়টি আদালতকে অবহিত করলেই হয়ে যেতো।
এদিকে নির্যাতনে শিশু গৃহকর্মী সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সাদিয়ার বাবা ট্রলিচালক সাইফুল ইসলাম, মা আনোয়ারা বেগম, নানা মোহাম্মদ আলীসহ স্বজনদের পাশাপাশি জেলা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শক্তিপদ পাল, জেলা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী জয়শ্রী দাস লক্ষ্মী, সাধারণ সম্পাদক লুৎফুন্নাহার, নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের আহবায়ক শিক্ষাবিদ আবুল কালাম আজাদ, জেলা আমাদের আইনের চেয়ারম্যান নুর-ই-আলম চঞ্চল ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলমসহ স্থানীয় সচেতন মহলের অনেকেই ওই ঘটনায় গৃহকর্তা আহসান হাবিব শাকিলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা বা প্ররোচনা রয়েছে বলে উল্লেখ করে তাকেও দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। তাদের মতে, শিশু সাদিয়াকে গৃহকর্তা শাকিলের বাসায় তার স্ত্রী ঝুমুর একদিনে বর্বর নির্যাতন করেনি। দিনের পর দিন তার উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। আর গরম খুন্তির ছ্যাকায় মাথা, পেটসহ শরীরজুড়ে দগদগে ক্ষত নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও বিষয়টি গৃহকর্তা জানেন না, তা বলার সুযোগ নেই। বরং ক্ষমতার প্রভাবেই হয়তো তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। তারা ওই মামলায় দ্রুত তদন্ত শেষ করে ওই দম্পতিকে বিচারের মুখোমুখি করে ফাঁসির দাবিও জানান।
এ ব্যাপারে শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম শ্যামলবাংলা২৪ডটকমকে জানান, নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী সাদিয়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় ওই মামলায় পরবর্তী আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঘটনায় গৃহকর্ত্রীর স্বামী শাকিলের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি। তবে মামলাটি অতি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা হচ্ছে। সার্বিক তদন্তে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, শ্রীবরদী পৌর শহরের মুন্সীপাড়া মহল্লার দরিদ্র ট্রলিচালক সাইফুল ইসলামের মেয়ে সাদিয়া ওরফে ফেলি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব শাকিল ও রুমানা জামান ঝুমুর দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো। কাজে সামান্য ভুল হলেই গৃহকর্ত্রী ঝুমুরের বেদম প্রহার ও খুন্তির ছ্যাকার কারণে তার মাথায়, পিঠে ও কাধে গুরুতর জখম ও দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পরে ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে গৃহকর্মী সাদিয়াকে উদ্ধার ও গৃহকর্ত্রী ঝুমুরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে গৃহকর্তা শাকিল গা ঢাকা দেন। পরে গৃহকর্ত্রী ঝুমুরকে একমাত্র আসামি করে মামলা গ্রহণ করে থানা পুলিশ। ২৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় সে।