নজরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ ॥ করোনাভাইরাসের হটস্পট এখন ময়মনসিংহ বিভাগ। আক্রান্ত, মৃত্যু, ঝুঁকি, আতংক এই বিভাগে সবই বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলায় গত ১১ মে পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৬টি। তন্মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৩৫জন এবং মারা গেছে ৮ জন। বিভাগে ৬১ চিকিৎসক ও ৫২ নার্সসহ মোট ২১৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মোট আক্রান্তের প্রায় ৫০ভাগ স্বাস্থ্যকর্মী। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালেই প্রায় একশ’ করোনায় আক্রান্ত। নিজ কর্মস্থলে সুষ্ঠু চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ ভূক্তভোগী রোগী চিকিৎসকদের।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক স্বাস্থ্য ডাঃ মোঃ আবুল কাশেম জানান, ময়মনসিংহ বিভাগে গত ১১ মে পর্যন্ত ৬১ চিকিৎসক ও ৫২ নার্সসহ মোট ২১৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তন্মধ্যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩জন চিকিৎসক, ৩৩জন নার্সসহ মোট ১০৪জন স্বাস্থ্যকর্মী এবং ময়মনসিংহ জেলায় মোট ৩৯ চিকিৎসক, ৩৯ নার্সসহ ১৩৪ স্বাস্থ্যকর্মী। নেত্রকোণায় ৬জন চিকিৎসক, ৩ নার্সসহ ১৮ স্বাস্থ্যকর্মী, জামালপুরের সিভিল সার্জনসহ চিকিৎসক ১২ ও ১০ নার্সসহ ৪৫ স্বাস্থ্যকর্মী, শেরপুরে ৪ চিকিৎসকসহ ১৯ স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বিভাগে মোট সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫৮জন এবং মোট চিকিৎসাধী রোগীর সংখ্যা ২৬৪জন।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেরর ডাঃ চিত্তরঞ্জন দেবনাথ জানান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবে কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার কিছু নমুনাসহ ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় ১১ মে পর্যন্ত মোট করোনা নমুনা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ পিসিআর ল্যাবে মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েঠেছ ৬ হাজার ৬৬২টি। তন্মধ্যে মোট করোনা পজিটিভ হয়েছে ৪৪৭ জনের।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বিএমএ ও স্বাচিপ ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ডাঃ মতিউর রহমান ভূইয়া জানান, সরকারের একই হাসপাতালে ননকোভিড ও কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করা ছাড়া উপায় নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় চিকিৎসার জন্য রোগীদের চরম হয়রানির শিকার করা হচ্ছে এবং সংক্রমণের হারও বাড়ছে কার্যকর ট্রায়াজের মাধ্যমে, রোগীদের একই হাসপাতালের তিনটি বিভাগে রাখা যেতে পারে, ননকোভিড, সন্দেহযুক্ত কোভিড এবং কোভিডে বিভক্ত। সেক্ষেত্রে ডায়াগনস্টিক সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং নমুনা সংগ্রহের দিন প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এন্টিজেন অ্যান্টিবডিভিত্তিক দ্রুত পরীক্ষা সম্পর্কে চিন্তা করা জরুরি।
ময়মনসিংহ বিভাগ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান জানান, চিকিৎসাসেবাকে যদি একটি ট্রেন ধরা হয়, সেই ট্রেনটির চালক হলো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। সেই চালকই যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিকল হয়ে পড়ে এবং উপযুক্ত পরিবেশে চিকিৎসা না পায়, তাহলে সাধারণ করোনা রোগীদের চিকিৎসায় কী বেহাল দশা হবে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে এখনই জরুরি ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও বাস্তবভিত্তির উপায় খুঁজে বের করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় জাতির কাছে তাদের একদিন এর জবাবদিহি করতে হবে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে নিজ কর্মস্থলে সুষ্ঠু চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ ভূক্তভোগী রোগী চিকিৎসকদের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে থাকা চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্তত পাঁচজন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে টানাটানি, এক্সরে, ইসিজিসহ অন্যান্য ল্যাব পরীক্ষায় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আক্রান্ত এসব স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকাংশই নিজ আবাসস্থলের আইসোলেশনে।
গত শুক্রবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক চিকিৎসকের নিজ বাসায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দ্রুতই এক্স-রে, ইসিজি ও রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। পরে বিকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা হয় হাসপাতালের ওয়ান স্টপ সার্ভিসে। এমন দাবি একাধিক চিকিৎসকের।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় পরিষদের ময়মনসিংহ বিভাগীয় করোনা মনিটরিং সেলের সমন্বয়ক, বি.এম.এ ময়মনসিংহ জেলা শাখা ও বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ এইচ. এ. গোলন্দাজ জানান,
‘চিকিৎসকদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের আন্তরিকতা যথেষ্ট। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন প্রতিনিয়ত আতঙ্কে ভুগছেন। এমনকি যারা সেবা দিচ্ছেন তারাও উৎকণ্ঠায় আছেন।’ তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের নতুন যে ভবনটি করোনা ডেডিকেটেড করার কথা সেটি নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। খুব দ্রুতই করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল তৈরি না হলে সিলেটের চিকিৎসক মরহুম মইনের ভাগ্যই বরণ করতে হবে এখানকার অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে।’
এ ব্যাপারে মমেক হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. মো. জাকিউল ইসলাম জানান, এক্সরে মেশিনটা ভারী হওয়ায় উপরে তুলতে সমস্যা হয়। তবে খুব শিগগিরই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।