স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে শেরপুরে লকড্উানে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় মানুষের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। অন্যদিকে তাদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসছেন না এলাকার বিত্তবান-সম্পদশালী লোকজন। এছাড়া জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয় দায়িত্বশীলদের অনেকেই রয়েছেন দায়সারা ভূমিকায়। ফলে অসহায় মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি দিনদিন বাড়ছে তাদের দুর্ভোগ। অন্যদিকে কর্মহীন অভাবী মানুষের খাদ্য সহায়তায় এলাকার বিত্তবান ও দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন প্রশাসনসহ মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনের নেতারা।
জানা যায়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে ১৫ লক্ষ জনতা অধ্যুষিত শেরপুরে লকডাউনে হতদরিদ্র মানুষের প্রায় শতভাগই কর্মহীন হয়ে পড়ে- যাদের সংখ্যা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। সেইসাথে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি এবং তখন থেকেই অঘোষিত লকডাউন ও ১৫ এপ্রিল থেকে পুরোপুরি লকডাউনের প্রভাবে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষসহ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও কোন কোন ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই। ফলে বর্তমানে জেলায় কর্মহীন অসহায় মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই তৃতীয়াংশে। আর ওই প্রভাবের কারণে জেলার ৫টি উপজেলার কর্মক্ষম, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুকসহ শ্রমিক, দিনমজুর, হতদরিদ্র, দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকসহ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পরিবারে প্রায় ওইসময় থেকেই চলে আসছে খাদ্যাভাব- পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে কর্মহীন অসহায় হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাদের দুর্ভোগ।
অন্যদিকে কর্মহীন-অসহায় মানুষের মাঝে সরকারের খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, জেলায় ২ লক্ষ ২৯ হাজার কর্মহীন অসহায় মানুষকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ২৬ এপ্রিল রবিবার পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন চাল এবং অন্যান্য সামগ্রীসহ শিশুখাদ্য ক্রয়ে ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ওই বরাদ্দের বিপরীতে ইতোমধ্যে জেলার ৫টি উপজেলা ৫২ টি ইউনিয়ন ও ৪ টি পৌরসভায় উপ-বরাদ্দমূলে ৯শ ৫০ মেট্রিক টন চাল, চালের সাথে অন্যান্য সামগ্রীসহ শিশুখাদ্য ক্রয়ে প্রায় ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জেলায় ইতোমধ্যে সুবিধা পেয়েছেন প্রায় ৫৭ হাজার ২৫৭ জন কর্মহীন মানুষ। এছাড়া কর্মহীন অসহায় মানুষের সহায়তায় প্রশাসনের তহবিলে সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির রুমান ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করলেও সেই সহায়তায় এগিয়ে আসেননি অন্য কোন জনপ্রতিনিধি।

কিন্তু অবস্থা আর প্রয়োজনের তুলনায় ওই সব সরকারি ও দাতাদের দেওয়া সহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় কিছু মানুষের দুর্ভোগ কমলেও দুর্ভোগে থাকা অন্যদের অবস্থা অনেকটাই শোচনীয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা চলছেন অনাহারে-অর্ধাহারে। আর তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা সহায়তার হাত বাড়ালেও একদিকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহায়তা যেমন চোখে পড়ার মতো নয়, ঠিক তেমনি এলাকার বা সমাজের বিত্তবান ও সম্পদশালীরা অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছেন নিজ ঘরে। বৃহৎ পরিসরসহ নিজ এলাকাতেও বাড়াননি সহায়তার হাত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জেলার ৩টি নির্বাচনী এলাকার ৩ জন সংসদ সদস্য যথাক্রমে হুইপ আতিউর রহমান আতিক, বেগম মতিয়া চৌধুরী ও প্রকৌশলী একেএম ফজলুল হক চাঁন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমানসহ ৫ উপজেলা চেয়ারম্যান ও ৪ পৌর মেয়রের সবাই আওয়ামী লীগ দলীয় এবং জেলার ৫২ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫ জন চেয়ারম্যানই একই দলের। তারা দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক স্ব-স্ব এলাকায় জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সরকারি সহায়তা প্রদানে সচেষ্ট থাকলেও তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সহায়তা মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করছে না। আর সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি এডভোকেট ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীসহ দলের কিছু নেতা স্ব-স্ব এলাকায় সহযোগিতার হাত বাড়ালেও দলের ৮০/৯০ ভাগ নেতারাই রয়েছেন হাত গুটিয়ে। অন্যদিকে জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেল তার নির্বাচনী এলাকা শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) তে জনসচেতনতামূলক প্রচারণাসহ কিছু খাদ্য সহায়তা চালিয়ে গেলেও অন্য দু’টি নির্বাচনী এলাকা বা ৩টি উপজেলাতেই তার দলের নেতাদের নেই কোন তৎপরতা। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা রয়েছে শূন্যের কোঠায়।
সর্বোপরি করোনাজনিত অসহায় মানুষের এ কঠিন দুর্ভোগেও জেলার কোটিপতি ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন একেবারেই নীরব দর্শকের অবস্থানে। সূত্রমতে, কৃষি ও খাদ্যের পাশাপাশি শিল্পসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে বড় ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক-স্বত্ত্বাধিকারীসহ ঠিকাদার-ব্যবসায়ী মিলে কোটিপতি বিত্তবান-সম্পদশালী রয়েছেন প্রায় ২ শতাধিক। আর তাদের মধ্যে ৮/১০ জন রয়েছেন শত কোটি টাকার সম্পদশালী ব্যক্তি। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ মহাদুর্যোগে জেলা সদরসহ ৫টি উপজেলায় সেই কোটিপতি সম্পদশালীদের দু’চারজনকেও সহায়তায় হাত বাড়াতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে দেওয়া সহায়তায় কমছে না কর্মহীন অসহায় মানুষের দুর্ভোগ।
এদিকে ওই অবস্থায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই কর্মহীন অসহায় মানুষের সহায়তায় বিত্তবান-সম্পদশালীসহ দানশীল লোকজনকে স্ব-স্ব এলাকায় সহায়তার হাত বাড়াতে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন জেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি রাজিয়া ছামাদ ডালিয়া। তিনি বলেন, সরকারী সহায়তার পাশাপাশি পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও স্বেচ্ছাসেবী কিছু প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সহায়তার হাত বাড়ানো হলেও আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের মতো সম্পদশালী লোকজনও ব্যক্তিগত সহায়তায় এগিয়ে আসছেন না। এতে পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় এখন মধ্যবিত্তরাও অসহায়ত্ববোধ করছে।
জেলা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মিনহাজ উদ্দিন মিনাল বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে জাতির মহাদুর্যোগে ভিক্ষুক নজিম উদ্দিন তার ভিক্ষে করে জমানো ১০ হাজার টাকা অসহায়দের সহায়তায় দান করে এ পরিস্থিতিতে নীরব থাকা আমাদের দায়িত্বশীল ও সম্পদশালীদের চপেটাঘাত করেছে-যার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। কাজেই ভিক্ষুক হয়েও হৃদয়ের দিক দিয়ে সম্পদশালী নজিম উদ্দিনের কাজ থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করা উচিৎ। আর নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কথা উদ্বৃত করে বলেন, ‘খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, হয়েছে সুষম বন্টনের অভাবে’। কাজেই চলমান পরিস্থিতিতে সহায়তা বিতরণে আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল সমন্বয়ের। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সে আহবানই জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে যে যার মতো করে সহায়তা দিয়ে-যাচ্ছে, বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। তার মতে, হতদরিদ্রসহ লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া ইমাম-মুয়াজ্জেন, শিক্ষকসহ স্বল্প আয়ের লোকজনের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে সেই তালিকা মোতাবেক জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও সম্পদশালীদের এলাকা ভাগ করে নিয়ে ত্রাণ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে করোনা রোগীর চিকিৎসা, মৃত্যুর পর তার দাফন-কাফন বা সৎকার, অভাব ও নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
