জুবাইদুল ইসলাম, শেরপুর : প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে শেরপুরে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারসামগ্রী পাবেন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া ২ লাখ ২৯ হাজার অসহায় মানুষ। ২২ এপ্রিল বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ রজনীগন্ধায় সাংবাদিকের সাথে এক মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব ওই তথ্য জানান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ৫০ হাজার মানুষকে ওই উপহারসামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। চলমান ওই কর্মসূচিতে অন্যদেরও পর্যায়ক্রমে ওই সহায়তায় দেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় এখন পর্যন্ত কয়েক দফায় জেলায় ৯শ মেট্রিক টন চাল, অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ে ৪৮ লাখ টাকা ও শিশু খাদ্য ক্রয়ে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ওই বরাদ্দের বিপরীতে ইতোমধ্যে জেলার ৫টি উপজেলা ৫২ টি ইউনিয়ন ও ৪ টি পৌরসভায় উপ-বরাদ্দমূলে ৭শ ৫০ মেট্রিক টন চাল, চালের সাথে অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শিশু খাদ্য ক্রয়ে ৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জেলায় ইতোমধ্যে সুবিধা পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার কর্মহীন মানুষ। ওই সহায়তা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য সহায়তা পেতে সরাসরি জেলা প্রশাসনের হটলাইন ও জাতীয় হটলাইন ৩০৩-এ মোবাইল করে মানুষ সহায়তা পাচ্ছে। মানুষকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ব করতে জেলায় ই-মার্কেটিং সেবা চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের পরিচালিত নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন ভঙ্গের দায়ে ২৩৩ জনকে জরিমানা করা হয়েছে- যার মাধ্যমে আদায় হয়েছে ৬ লাখ ৬২ হাজার ৬শ টাকা।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সমগ্র জেলায় লিফলেট ও মাইকিং প্রচারণাসহ জনসচেতনতা বাড়াতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও মোড়ে বসানো হয়েছে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বেসিন। পৌরসভা ও ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় শহর থেকে শুরু করে গুরুত্বúূর্ণ এলাকা, সড়কসহ হাট-বাজারে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে- যা এখনও চলমান রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে জেলায় প্রায় ৭০ টি হাট-বাজার স্থানান্তর করে মুক্ত জায়গায় নেয়া হয়েছে।
জেলা করোনা সংক্রমণ ও চিকিৎসা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন আক্রান্ত হলেও ইতোমধ্যে ৫ জন চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এখন পর্যন্ত ভর্তি থাকা অন্যান্য রোগীরাও ভাল অবস্থায় রয়েছেন। তিনি বলেন, করোনায় সন্দেহভাজনদের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে আক্রান্তদের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য বিভাগের বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন তাই চিকিৎসকদের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করতে জেলা যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে ৬৮ টি বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে আক্রান্তদের জন্য জেলা সদর হাসপাতালসহ ৫ টি উপজেলায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে আইসোলেশন ওয়ার্ড করে ব্যবহারসহ ব্যবহার উপযোগী রাখা হয়েছে ১৫০ টি বেড। এছাড়া আরও ২১ টি বেসরকারি ক্লিনিকে ১০৩ টি বেড প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি লকডাউন পরিস্থিতিসহ রমজানে যেন খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের বাজারমূল্য স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল থাকে-সে জন্য চেম্বার অব-কর্মাসের সাথে সমন্বয় রেখে বাজার মনিটরিং হচ্ছে এবং তা নিয়মিত চলমান থাকবে। এক্ষেত্রে কোন অসাধু ব্যবসায়ী মূল্য বৃদ্ধিসহ বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা (জিরো টলারেন্স) নীতি প্রয়োগ করা হবে- কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে খাদ্য উদ্বৃত্ত এ অঞ্চলের চাতালগুলো যেন চালু রাখা যায় সেজন্য চালকল মালিক সমিতির সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থায় শিথিল করা হবে।
এদিকে লকডাউনে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক জেলা প্রশাসনের সহায়তায় থাকবে বলে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। কৃষকদের উৎপাদিত ধান কাটার সময় ঘনিয়ে এলেও তারা অর্থ ও শ্রমিক সংকটের কারণে দুঃশ্চিন্তায় ভোগছেন। তাই কৃষি বিভাগসহ উপজেলা প্রশাসনকে তাদের পাশে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে হারভেস্টিং মেশিন ব্যবহারের পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমকে কাজে লাগাতে প্রস্তুতি চলছে। এজন্য যারা স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহী ও তাদের পাশে দাঁড়াতে চায়- তাদেরকেও উৎসাহিতকরণে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মতবিনিময়কালে পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকা ব্যতিত প্রতিটি গ্রাম/মহল্লায় খাদ্য সহায়তা বিতরণে বৈষম্য করছেন এবং শেরপুর পৌরসভাসহ অধিকাংশ ইউনিয়নে বৈষম্যের শিকার এলাকাগুলোতে এখনও সরাসরি জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা না পৌঁছার বিষয়ে দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি অনেকটাই জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বের অংশ। এরপরও যে সমস্ত এলাকায় এখনও সহায়তা পৌঁছেনি সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রæত পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবশেষে তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সাহসিকতা ও আন্তরিক সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, করোনা যুদ্ধে গণমাধ্যম কর্মীরাও অগ্রসৈনিকের ভূমিকায় রয়েছেন, তাদের সহযোগিতা নিয়েই আমরা করোনার মতো যেকোন দুর্যোগে সূর্যোদয় দেখতে চাই। ওই সময় সাংবাদিকদের মধ্যে পরামর্শমূলক কথা বলেন প্রেসক্লাবের সভাপতি শরিফুর রহমান, সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আধার, সাধারণ সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবিহা জামান শাপলা, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আদিল মাহমুদ উজ্জল, সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুর রহিম বাদল, দেবাশীষ সাহা রায়, সঞ্জীব চন্দ বিল্টু, হাকিম বাবুল প্রমুখ।
মতবিনিময়কালে অন্যানের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এবিএম এহছানুল মামুন, ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ, এনডিসি মিজানুর রহমান ও জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডাঃ খাইরুল কবীর সুমনসহ স্থানীয় সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে ওই মতবিনিময় সভা শেষে জেলার তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের (হিজড়া জনগোষ্ঠী) মাঝে ফের প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব। এরপর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে চিকিৎসকদের জন্য জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ১০টি খাট প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে খাটগুলো গ্রহণ করেন জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডাঃ খাইরুল কবীর সুমন। ওইসময় জেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।