করোনায় পরিবর্তিত রোজনামচায় এবার লিখতে হচ্ছে সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ নিয়ে একটি বিশেষ লেখা। ৮ এপ্রিল ‘করোনায় রোজনামচা; বাড়ছে দেনা’ শীর্ষক আমার লেখাটি কারিগরি ত্রুটির কারণে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) শ্যামলবাংলা২৪ডটকম এ প্রকাশিত হলে অনেকের ধন্যবাদসূচক মন্তব্যের পাশাপাশি একজন ভক্ত-সুহৃদের অনুরোধ ছিলো ইতোপূর্বে জাতীয় প্রেক্ষাপটে আমার ‘আর নয় চুলোচুলি, কোলোকুলিতে হোক সমাধান’ এবং ‘হাতকড়া পড়া শিক্ষক ও হাতকড়া পড়ানো রাজনীতি’ শীর্ষক লেখা দু’টি নাকি বেশ উপভোগ্য হয়েছিলো। অবশ্য এ কথা আগেও তিনি বলেছিলেন। তাই একই আদলে করোনাকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে যেন একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখি। আর সে আলোকেই আজকের নিবন্ধ ‘করোনায় রাজনীতি এবং রাজনীতির করুণা’।
এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, রাজনীতি এখন সামষ্টিক অর্থে ‘রাজার নীতি’তে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের তথা দেশ ও জাতির উত্তরণ, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির দর্শন। আর সেই রাজনীতির মাধ্যমে কোন দল বা সংগঠন একটি দেশ বা জাতিকে নিয়ে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে বা দেখায়। আবার কোন দল বা সংগঠন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দেশ পরিচালনার চেষ্টা করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার ভঙ্গ করলে সংসদে ও বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলো তার সমালোচনায় মুখর হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ্যাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলগুলোর অবস্থানও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই এ জন্য যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানসহ তার ভিত্তি মজবুত করতে বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিসীম। সুতরাং রাজনীতির মর্মার্থই হচ্ছে দেশ ও জাতির কল্যাণ।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের শতাব্দীর নজিরবিহীন ছোবলে বিশ্বময় ধসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের টালমাটাল অবস্থায় আমাদের রাজনীতি কি সে পথে পরিচালিত হচ্ছে? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলগুলো কি মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলায় কাজ করছে বা অগ্রসর হচ্ছে ? নাকি উল্টো দেশে করোনা নিয়েই রাজনীতি হচ্ছে?
এ কথা আমাদের অজানা নয় যে, করোনা পরিস্থিতির এখন চতুর্থ বা চূড়ান্ত ধাপ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ভাইরাসটি এখন স্থানীয় ও সামাজিক পর্যায়েও সংক্রমিত হচ্ছে। ফলে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার ও গোটা জাতি। কিন্তু জাতির দূর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, এ কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দূরে থাক, অন্ততঃ যার যার অবস্থান থেকে উদারতা বা করুনা প্রদর্শন করছে- এমন নজিরও খুব একটা চোখে পড়ে না। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারকে নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতা ও ধৈর্য্যরে সাথে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে দায়িত্বে ফেরানোর মধ্য দিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনছেন। কর্মহীন, অসহায় মানুষদের মাঝে মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সামগ্রী বিতরণসহ নানা সহযোগিতা অব্যাহত রাখতেও কাজ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতিও কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন সাহসিকতার সাথে কাজ করতে। কিন্তু তার সেই নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিটি এলাকায় যতোটুকু সক্রিয় ও তৎপর হওয়ার কথা দলীয় নেতাদের, সব এলাকায় ততোটুকু তৎপর নয় তারা। কোন কোন এলাকায় দলের দায়িত্বশীল নেতারা সক্রিয় থাকলেও অধিকাংশ এলাকাতেই রয়েছেন নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোন তৎপরতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কাছ থেকে জাতি যা আশা করেছিলো তা না পেলেও তারা আবার সরকারের সমালোচনায় ভুল করছে না। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াত অনেক ক্ষেত্রে কৌশলে তাদের কাজটা ঠিকই করে যাচ্ছে- এমন তথ্যও পাওয়া যায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে প্রায় এলাকাতেই দানশীল ব্যক্তি ও স্থানীয় উদ্যোগে সহায়তা বেড়েছে। সামাজিক দূরত্বের বাধ্যবাধকতা কাছে না টানলেও বেড়েছে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ। মোদ্দাকথা- খোদ জাতির জন্য একটি কঠিন সময়েও যদি মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া না যায় বা যার যার অবস্থান থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে না পড়া যায়, তবে সে রাজনীতি কিসের তরে? নির্বাচনের প্রাক্কালে নিবন্ধিত দল ছাড়াও অনেক ভূইফোড় দলেরই আর্ভিভাব ঘটে। কিন্তু এখন সেগুলো দূরে থাক, নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যেও অধিকাংশেরই নড়াচড়া চোখে পড়ে পড়ে না। বরং সার্বিক অবস্থা সামাল দিতে দেশ ও জাতির প্রতি শেখ হাসিনার উদার নৈতিক মানসিকতা ও করুণার পাশাপাশি এক নির্বাহী আদেশে দূর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি প্রধান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খণ্ডকালীন মেয়াদে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট করুণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে যুগপৎ আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে।

মূলতঃ বাস্তবতা হচ্ছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪র্থ দফায় সরকার গঠন হয়, অন্যদিকে তেমনি মাত্র ৭টি আসন পেয়ে বিএনপির রাজনীতির ধস নামে। ভেঙ্গে পড়ে তাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড। এ ছাড়া দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া সাজার বোঝা নিয়ে কারাগারে এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া সাজা মাথায় নিয়ে বিদেশে থাকায় মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে দলকে সেভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে, বিএনপির রাজনীতি করোনা পরিস্থিতির বেশ আগে থেকেই করুণ বৈ কি!
অন্যদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলোতে কাছে টানতে ব্যর্থ হোক বা না হোক রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বেশ জোরেসোরে আলোচিত হচ্ছে যে, শেখ হাসিনার সরকার এবং দল অনেকটা পৃথক হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারের নির্ভরতা বেড়েছে বিভাগীয় আমলা ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দল ও সরকারের দূরত্বের এটিও একটি কারণ। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত আমলা নির্ভরতার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েছে প্রশাসনযন্ত্রের ভাব ও অহমিকা। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে দল বা দলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়রন বা অবমূল্যায়নের হিসেবে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে। আর এমনই অবস্থায় দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা অসাধু চক্রের দোসররা কোন কোন এলাকায় করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন, অসহায় মানুষদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের চেষ্টা করছে। আর বিশেষ অবস্থায় এটাই যেন তাদের রাজনীতি, যে রাজনীতির অর্থ বিএনপি-জামায়াত জোটের মতো ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে লুটেপুটে খেয়ে তাজা হওয়া। অবশ্য চোর-দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
সুতরাং সার্বিক অবস্থায় বলা যায়, প্রাণঘাতি করোনার আঘাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলা ও মানুষের কল্যাণে সরকারের বাইরে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যতটা এগিয়ে আসা উচিত ছিলো, ঠিক ততোটা এগিয়ে আসেনি। আর বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলগুলো কার্যত অগ্রসরই হয়নি। তাদের মাঝে করোনায় জাগেনি করুণা! কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বলতে হয়, সকলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এবং তাতে সফল হওয়াটা যতটা সম্ভব, সরকারের একা বা নিজ দলসহ সরকারের পক্ষে তা এখনো কঠিন থেকে কঠিনতর। তাই শতাব্দীর সর্বকঠিন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সকলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কোন বিকল্প নেই। এটা জানার পরও যদি রাজনীবিদদের নীরবতা না ভাঙে, নীরব থাকে মানবতা ও কল্যাণের রাজনীতি, আর দেশ ও জাতির চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখেও যদি জাগ্রত না হয় বিবেক, মমত্ব ও মানবতাবোধ- তবে নেই প্রয়োজন সেই রাজনীতির। বরং ধিক! সেই রাজনীতির, ধিক! অপরাজনীতি।
তারিখ : ১০/০৪/২০ইং
লেখক : সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিক, শেরপুর, ই-মেইল-press.adhar@gmail.com
