জাহিদুল খান সৌরভ ॥ শহুরে কোলাহল ও নাগরিক ব্যস্ততা থেকে একটু বিনোদন মানব জীবনে সকলের প্রয়োজন। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুরে যেতে পারেন ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার গজনী অবকাশ বিনোদন কেন্দ্র থেকে। ভারত সীমান্ত ঘেষা উঁচু-নিচু পাহাড় বেষ্টিত এই পর্যটন কেন্দ্রে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে শীতকালে নতুন বছরের শুরুতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গারো পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এক লীলাভূমি। আর তাই শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশের পাদদেশে অবস্থিত সারি সারি শাল, গজারি, সেগুন, ছোট-বড় মাঝারি টিলা, লতাপাতার বিন্যাস যা প্রকৃতি ও পর্যটন প্রেমীদের মনে নিশ্চিত দোলা দিয়ে যাবে। শেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের প্রায় ৯০ একর পাহাড়ি এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। গড়ে উঠার পর থেকেই প্রতিবছর ক্লান্ত জীবনের ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে অবসরে হাজারও পর্যটক ভিড় করেন এই গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।
এই জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়,গহীন জঙ্গল, টিলা, মাঝে-মাঝে সমতল। দুথপাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে এগিয়ে চলা স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝর্ণা। পাহাড়, বনানী, ঝর্ণা, হ্রদ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনীতে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী) আপনাকে স্বাগত জানাবে, তারপর রয়েছে ডাইনোসরের বিশাল প্রতিকৃতি, ড্রাগন ট্যানেল, দণ্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার, নিকুঞ্জ বন ও আলোকের ঝর্নাধারা। পূর্বে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানা থাকলেও নতুন করে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো
বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, হনুমান, গন্ধগোকুল,সজারু,কচ্ছপ, বাজপাখি, খরগোশ এবং ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণী। শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরি হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে যেখানে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। উঁচু পাহাড় কেঁটে তৈরি হয়েছে মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত। এছাড়াও রয়েছে আগত শিশু দর্শনার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্ক, সেখানে ফ্লাইওভার গজনী এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিশু কর্নার, সুপার চেয়ার, নাগরদোলা ও মেরিগো। গজনী অবকাশে থাকছে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কর্নার। ‘পর্যটনের আনন্দে তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর এ স্লোগানে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য নির্মিত ব্র্যান্ডিং কর্নারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিওচিত্র থাকবে। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলসীমালা চালের জন্যও থাকবে আরেকটি আলাদা নির্দিষ্ট স্থান। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য এবার নতুন তৈরি করা হচ্ছে ক্যাবল কার। যা গজনী অবকাশে আগত ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনের জন্য আলাদা মাত্রা যোগ করবে। এছাড়াও গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য ড্রাগন ট্যানেল।অবকাশকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০ বর্গফুট উচ্চ এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পুরো গজনী অবকাশের পাহাড়ি টিলার অপরূপ সৌন্দর্যময় সবুজ দৃশ্য।পাহাড়ী পরিবেশ গজনীতে শুধু ঘুরবেন কিছু কিনবেন না তা কি করে হয়। অবকাশ কেন্দ্রের ভিতরে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান। যেখানে রয়েছে ছোট্র সোনামনিদের জন্য প্রায় সব ধরনের খেলনা, মহিলাদের জন্য সকল প্রকার আনকমন প্রসাধনী, চাদর, শাল, থ্রি-পিছ, পুরুষদের জন্য বিভিন্ন রংয়ের পাঞ্জাবী, টুপি, সানগ্লাস, হর্সম্যান ক্যাপ সহ রান্না-বান্নার কাজে প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র।
গজনীতে খাবারের হোটেল গুলিও বেশ উন্নত মানের ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে রয়েছে সাদা ভাত, দেশী মুরগীর মাংশ, গরুর মাংশ, ছোট মাছ সহ দেশীয় প্রায় সব ধরনের ভর্তা। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের ভিতরে কথা হয় গাজীপুর থেকে আসা সরকারী চাকুরীজীবী মোঃ আব্দুর রহমানের সাথে, তিনি বলেন গজনীর এ নয়নাভিরাম ও মনোমুগ্ধকর পাহাড়ী পরিবেশে ঘুরতে কার ভালো লাগে। তাই ইচ্ছে করে প্রতিবছরই এখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরী করতে হয় বলে সে সুযোগ হয়ে উঠে না। তবুও শত ব্যস্ততার মাঝে সময় পেলে ঠিকি শেরপুরের এ অন্যতম পিকনিক স্পট গজনী অবকাশে ছুটে আসি। এবার নিয়ে আমি ৪র্থ বারের মত আসলাম।চুকুলুপি চিলড্রেন পার্কে কথা হয় লাবনীর সাথে, সে জানায় নেত্রকোনা জেলার শ্যামগঞ্জ শালদিগাঁ গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেনীর ছাত্রী। শেরপুরের গজনী অবকাশের অনেক কথা সে তার মামা রতনের কাছে শুনেছে। তখন থেকেই লাবনী গজনীতে আসার কথা ভাবতো। আজকে তার সে আশা পূর্ণ হয়েছে। সেজন্য লাবনী তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (হেড মাষ্টার) কে ধন্যবাদ জানায়। নেত্রকোনা থেকে তারা মোট ৫৭ জন এসেছে। যাদের মধ্যে ৭ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও বাকী ৫০ ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। লাবনী আরও জানায়, এখানে এসে সে বড় বড় পাহাড় দেখেছে, মস্তবড় অজগড় সাপ , হরিন , সজারু, কচ্ছপ সহ পাহাড়ী ঝর্ণাও দেখেছে।গজনী অবকাশ নতুন রূপে সজ্জিত হওয়া ও প্রশাসনের সহযোগিতার ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (উপসচিব) এটিএম জিয়াউল ইসলাম বলেন, গারো পাহাড় ঘেরা গজনী অবকাশ ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের একটি অন্যতম জায়গা। তাই এর নিরাপত্তার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন যথেষ্ট আন্তরিক। পুরনো আয়োজনের পাশাপাশি আগতদের জন্য নতুন নতুন আরও স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হচ্ছে।