ড. আবদুল আলীম তালুকদার

প্রতি বছর বাঙালি জাতির দ্বারে গৌরবময় মহান বিজয় দিবস আসে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। এ দিনটি আমাদের জন্য একটি আত্মসমীক্ষার দিনও বটে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর ইতোমধ্যে ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের যেমন অনেক অর্জন রয়েছে তেমনি ব্যর্থতাও কিন্তু কম নয়। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম ভিত্তি ছিল অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ; আর মূল লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম, সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
যে রাষ্ট্রের মর্মবাণী হবে গণতন্ত্র, যে রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ মুক্তির স্বাদ নিয়ে বসবাস করবে; মানুষের মত প্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনতা স্বীকৃত হবে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, অর্থনৈতিক সূচকে আমরা এগিয়ে চলেছি বীরদর্পে; জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, গড় আয়ু বৃদ্ধি, বাল্য বিবাহের হার হ্্রাস এবং শিশুমৃত্যু হার হ্রাসের সূচকে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও সমাদৃত। অর্থনীতির গবেষক জেপি মরগান বিশ্বের ৫টি অগ্রসরমান অর্থনীতির তালিকায় বাংলাদেশকে সম্মানজনক অবস্থানে রেখেছেন। গোল্ডম্যান স্যাক্সের সম্ভাবনাময় ১১টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ‘নেক্সট ইলেভেন’ এর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
বিজয় দিবস আমাদের জয়দীপ্ত গর্বের নিদর্শন। বাঙালি জাতি এই দিনের বিজয়ের সূত্রেই বীর জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এই দিনেই বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে জয়যাত্রা শুরু। এই দিনটির মাধ্যমেই আমরা নতুন প্রজন্মকে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়কে বারবার স্মরণ করিয়ে দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা, শহীদদের কথা; মনে করিয়ে দেই বাংলাদেশ নামক একটি দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা; যা প্রতিটি বাঙালি তার হৃদয়ে ধারণ করে আছে। তাই প্রতিটি বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বর গভীর তাৎপর্য বহন করে।
এতোসব গৌরবগাঁথা, সাফল্য এবং নানাবিধ অর্জনের পরও আমাদের কিছু কিছু কাজ সমস্ত সফলতার রঙ ফিঁকে করে দেয়; চির উন্নত শিরকে অবনত করে দেয়। বিশেষ করে জাতীয় রাজনীতির কলুষতা, সুশাসনের ঘাটতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়, কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় অবৈধভাবে বিভিন্ন পণ্যের মজুদদারী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ও জাতীয় পরিসরে গণতান্ত্রিক চর্চার ঘাটতি আমাদের এখনো প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তোলে। আমরা সবাই জানি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার কিছু লক্ষ্য থাকে এবং আমাদেরও ছিল। সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তা অর্জিত হয়েছে।
ফলে জন-সমর্থিত এ লক্ষ্যগুলো অর্জিত না হলে এ বিজয়কে সার্বিক অর্থে বিজয় বলা যেত না। এটা অবশ্যই সত্যি যে, পরাধীনতা ও পরশাসন থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি সত্যি, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতাও পেয়েছি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে যে কথাটি দু:খজনকভাবে বলতে হচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে আমাদের দেশে বিভাজনের রাজনীতি ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং তা কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ক্রমশ: ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় ঐক্যের বদলে একই দেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি-বিভাজন, বিভেদ-সংঘাত এবং হিংসা-বিদ্বেষ বিস্তৃত হওয়া যে কোন জাতির জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। এটা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে নি:সন্দেহে সাংঘর্ষিক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাতীয় ঐক্যই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। যদিও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমতা বিধান করা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলেও এখন দিন দিনই ধনী-দরীদ্রের ব্যবধান ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর গুম, খুন, দুর্নীতি, রাহাজানি, হত্যা, চুরি-ডাকাতি সবমিলে নাগরিক জীবনের উৎকণ্ঠা এখন বেড়েই চলছে। আমাদের মাঝখান থেকে সহনশীল মনোভাব কেন যেন ওঠে যাচ্ছে।
তাই সর্বোপরি দেশের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক নানান সংকট নিরসনে কার্যকর ও যৌক্তিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এই বন্ধ্যাত্ব দীর্ঘমেয়াদী হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সর্বত্রই। এহেন পরিস্থিতিতে সকল রাজনৈতিক দল তথা সমগ্র বাঙালি জাতি পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একে অপরের প্রতি সহানুভুতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা প্রদর্শন করা বাঞ্ছনীয়; সেই সাথে দেশের প্রতিটি নাগরিক আরো বেশী বেশী স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে এসব সঙ্কটের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।
মানবতার ধর্ম ইসলামে স্বদেশকে ভালোবাসার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইসলামের মহান বাণী হলো, দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র জীবনাদর্শ ও স্বভাব-চরীত্রে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি নিজের মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে ফিরে কাতর কণ্ঠে হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী স্বাধীনতা মহান আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বড় নিয়ামত। ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা শাশ্বত সত্য বলে ইসলামে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম মনে করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের মঙ্গলার্থে কিছু করতে পারা, দেশের মানুষের কল্যাণে সর্বদা নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে পারা নি:সন্দেহে বিরাট গৌরবের বিষয়। নবী করীম (সা.) সারাটা জীবন এ শিক্ষাই তার অনুসারীদের দিয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ’।
অষ্টম হিজরীতে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন বিজয়ী বেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তার স্বগোত্রীয় লোকেরা হারাম শরীফে অপরাধী হিসেবে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। এমন মুহূর্তে স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা দেশের সীমানা রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে তাদের সম্পর্কে হযরত রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘একদিন ও একরাতের সীমান্ত পাহারা ধারাবাহিকভাবে এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম।’ -সহীহ্ মুসলিম
প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেম মমত্ববোধ, মহত্ত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মহান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে স্বদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার শিক্ষা দেয়। তাই সর্বাগ্রে আমাদের প্রয়োজন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও এই বিজয়কে অর্থবহ করতে দল, মত, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশের জন্যে সকল স্বার্থ ত্যাগ করার মন মানসিকতা তৈরি করা এবং দেশকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসতে নিবেদিত প্রাণ হওয়ার অনুশীলন করা; তাহলেই সুখী-সমৃদ্ধশালী, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব।
এ কথা আজ গর্বের সাথেই বলা যায় যে, দীর্ঘ প্রায় ৪ যুগের স্মৃতি জড়িয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ পদার্পণ করেছে আশা ও আনন্দের একটি নতুন শতাব্দীতে। সেইসাথে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার যে প্রচেষ্টা চলছে সেটাও একটি মহৎ দৃষ্টান্ত। পক্ষান্তরে প্রাপ্তির আলোয় আজ প্রত্যাশাকে দেখার সময়, সামনে এগিয়ে যাবার পরম ক্ষণ-ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মুহূর্ত। তাই বিগত বছরগুলোর সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে তা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। শপথ নিতে হবে সুখী-সমৃদ্ধ-কল্যাণকর সমাজ গঠনের। ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের মিনার। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বাঙালির আপন শক্তিতে। পরিশেষে কামনা একটাই জয় হোক বাঙালির, জয় হোক মানবতার।
লেখক: কবি, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর।
