সাড়ে ৬ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক অস্বীকার করে উল্টো জালিয়াতির মামলা প্রতারক স্বামীর
স্টাফ রিপোর্টার ॥ শেরপুরে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের ঘটনায় পাষণ্ড স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে বিপাকে পড়েছে সোমাইয়া আক্তার (২৪) নামে এক শারীরিক প্রতিবন্ধী। ওই মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক বেমালুম অস্বীকার করে উল্টো প্রতিবন্ধী সোমাইয়া আক্তারের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দিয়েছে প্রতারক-পাষণ্ড স্বামী ইব্রাহিম খলিল। এতে হতাশ ও হতবাক হয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছে সেই প্রতিবন্ধী।
জানা যায়, শেরপুর সদর উপজেলার কুমড়ি কাটাজান গ্রামের কৃষক মৃত ইকাতুল্লাহর ৭ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ শারীরিক প্রতিবন্ধী সোমাইয়া আক্তার। প্রায় ৩ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে তার দু’পা অচল ও ক্ষীণকায় হয়ে যায়। তারপর থেকেই হাতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয় তাকে। এরপরও সে অন্যদের মতো স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করে। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হয় কুমড়ি তেঘরিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। ২০১২ সালের প্রথম দিকে শহরের ফার্স্ট টাইম নামে একটি কোচিং সেন্টারে কোচিং করতে গিয়ে পরিচয় হয় সদর উপজেলার দীঘলদি গ্রামের শামছুল হকের ছেলে ইব্রাহিম খলিলের সাথে। ইদ্রিসিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইব্রাহিম তখন ওই কোচিং সেন্টারে আলিম পরীক্ষার কোচিং করছিল। সেই পরিচয়ের পর সম্পর্ক এবং সম্পর্কের সূত্রে এক পর্যায়ে ২০১২ সালের ১০ আগস্ট তারা বিয়ে করে। এরই মধ্যে সোমাইয়া ২০১৩ সালে দাখিল ও খলিল আলিম পাস করে এবং খলিল একই প্রতিষ্ঠানে থাকলেও সোমাইয়া এইচএসসিতে ভর্তি হয় শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজে। তাদের বিয়ের বিষয়টি জানার পর খলিলের অভিভাবকরা তা মেনে না নেওয়ায় খলিল সোমাইয়াদের সংসারে চলে গিয়েই দাম্পত্য সম্পর্কের জীবন শুরু করে। দু’জনের পড়াশোনা ও সংসার খরচে টানা-পোড়েনে যখন সোমাইয়ার পরিবারের কষ্ট বাড়ে, ঠিক তখন আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনে সেলাইয়ের চাকরি নেয় সোমাইয়া। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৬-৮ হাজার টাকা পেয়ে সেই টাকাতেই সংসারে যোগানের পাশাপাশি খলিলের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করে আসছিল সোমাইয়া। ২০১৫ সনে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সোমাইয়া এক বিষয়ে অকৃতকার্য হলেও তার খরচে খলিল পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও পরবর্তীতে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে টাঙ্গাইল থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে নেয়। এরপরই সোমাইয়া তার এক আত্মীয়ের সহায়তায় খলিলকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ম্যাটাডোর কোম্পানীতে চাকরিতে ঢুকায়। এরপর সোমাইয়ার আশা ছিল, এবার কষ্টের বোঝা কমে আসবে, নেমে আসবে দাম্পত্য জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু বিধি-বাম। উল্টো চাকরিতে ঢুকার পর থেকেই সোমাইয়ার প্রতি চরম উদাসিন হয়ে পড়ে খলিল। তার খোঁজ-খবর রাখা তো দূরে থাক, বেড়ে যায় যৌতুকের দাবিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে খলিল জামালপুরের মিশু নামে মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে।
এদিকে সোমাইয়া বাধ্য হয়ে স্বামী ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে ১২ আগস্ট শেরপুরের সি,আর আমলী আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে এবং পারিবারিক আদালতে মোহরানা ও খোরপোষ আদায়ের দাবিতে দু’টি পৃথক মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে সমন পেয়ে যৌতুক নির্যাতন মামলায় হাজির হয়ে হাজতে গেলেও এক সপ্তাহ পর জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায় খলিল। এরপর শুরু হয় খলিলের প্রতারণার কূট-কৌশল। আর সেই কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ইব্রাহিম খলিল ৫ নভেম্বর প্রতিবন্ধী সোমাইয়া আক্তারের সাথে দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক অস্বীকার এবং তাদের মধ্যকার বিগত ১০/০৮/১২ তারিখে সংঘটিত কাবিননামাটি জাল-জালিয়াতি বলে দাবি করে সুমাইয়া আক্তার ও তার যৌতুক নিরোধ আইনের মামলার ৪ সাক্ষীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি পাল্টা মামলা ঠুকে দেয়। আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে ঘটনার বিষয়ে তদন্তপূর্বক চলতি ৬ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য জামালপুরের পিবিআই কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দেন। এরপর পিবিআইয়ের পরিদর্শক ফারুক হোসেন সরেজমিনে তদন্তে এলে মানীত সাক্ষীগণসহ আশেপাশের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন খলিল ও সোমাইয়ার বৈবাহিক-দাম্পত্য সম্পর্কের কথা। কেবল তাই নয়, তাদের রেজিস্ট্রি সম্পাদনকারী ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের সহকারী কাজী আব্দুল বাসিতও সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। কিন্তু বাধ সেধেছেন মূল কাজী সৈয়দ আহম্মেদ। তিনি তার দেওয়া এক প্রত্যয়নপত্রে ইব্রাহিম খলিল ও সোমাইয়া আক্তারের মধ্যকার বিবাহ রেজিস্ট্রি তার অফিসে হয়নি মর্মে উল্লেখ করেছেন। আর এ নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। ফলে অসহায় হয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আদালত, তদন্ত কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে প্রতিবন্ধী সোমাইয়া আক্তার।
শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গেলে কথা হয় প্রেমিক স্বামীর প্রতারণার শিকার প্রতিবন্ধী সোমাইয়া আক্তারসহ স্থানীয় লোকজনদের সাথে। ওইসময় সোমাইয়া নিজের অসহায়ত্বের বর্ণনা দিয়ে প্রতারক স্বামী ইব্রাহিম খলিলের বিচার দাবি করেন। স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান, ইউপি সদস্য মফিজুল ইসলাম, ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান লিটন, আমানুল্লাহ আমানসহ অনেকেই জানান, ইব্রাহিম খলিল ও সোমাইয়া আক্তারের দীর্ঘ বৈবাহিক-দাম্পত্য সম্পর্ক এবং সোমাইয়ার পৈত্রিক বাড়িতে একসাথে বসবাসের কথা। অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে ইব্রাহিম খলিল প্রথমে সোমাইয়াকে চিনেন না এবং তার সাথে সম্পর্কের প্রশ্নই উঠে না বলে দাবি করলেও পরে তার সাথে সোমাইয়ার মোবাইলে কথোপকথনের রেকর্ড শোনালে চুপসে যান। এরপর বলেন, আদালতেই প্রমাণ হবে কার অভিযোগ সত্য।
এ ব্যাপারে জাল-জালিয়াতির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলেন, নির্বাচনী দায়িত্বে ব্যস্ততার কারণে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে পিবিআইয়ের জামালপুর অফিসের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সীমা রানী সরকার খুব দ্রুতই ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ তদন্ত তদারকি করবেন। এরপরও প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।