ড. আবদুল আলীম তালুকদার
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ মুসলিম উম্মাহ্ অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি দেশে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও সিরাতুন্নবী (সা.) উদ্যাপন নিয়ে একটি প্রকাশ্য মতবিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যাপকহারে; এমনকি এ নিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শী আলিম-উলামাদের মাঝে তর্ক-বাহাস, পাল্টা-পাল্টি যুক্তি-উপমা উপস্থাপন এমনকি দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো মারমুখী কর্মকা- সংঘটিত হতেও দেখা যাচ্ছে। যদিও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও সিরাতুন্নবী (সা.) এর একটি অথবা দুটোই উদ্যাপন করা না করা ইসলামের মৌল উৎস সমূহের (Sources of Islam) অন্যতম কোন র্ফযিয়াতের তরক্ হওয়ার কোন বিষয় নয়। তবে নবী (সা.) যেহেতু সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ তাই উম্মতে মুহাম্মদী হিসাবে তাঁর জন্মোৎসব পালন, তাঁর জীবন-চরিত পাঠ ও তাঁর জীবনাদর্শ যথাযথ অনুকরণ-অনুসরণ করা প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য এবং নি:সন্দেহে তা মুসলিম উম্মাহর জন্য পালনীয় ও কল্যাণকর।
সিরাতুন্নবী (সা.) বলতে যেহেতু নবী করীম (সা.)’র সামগ্রিক জীবন-চরিতাদর্শকে বুঝায় আর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) বলতে শুধু নবী করীম (সা.)’র জন্মোৎসব পালনকে বুঝায়; তাই সিরাতুন্নবী (সা.)’র পালনের মাধ্যমেই মিলাদুন্নবী (সা.) স্বয়ংক্রিয়ভাবে পালিত হয়ে যায়। অতএব, এই মীমাংসিত বিষয়টাকে নিয়ে অহেতুক মতবিরোধ, মত-দ্বৈততা, পরস্পরে বিদ্বেষপূর্ণ উষ্মা প্রদর্শন মুসলিম উম্মাহ্র উখ্ওয়াত (Brotherhood) তথা দ্বীনি ভ্রাতৃত্ববোধের মাঝে ফাটল সৃষ্টি বৈ আর কিছুই নয়; যার কারণে এই সুযোগে দেশী-বিদেশী ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলিম মিল্লাতের অপূরণীয় ক্ষতি করার মওকা খুঁজে পাচ্ছে এমনকি প্রতিনিয়ত ক্ষতি করেও যাচ্ছে; যা আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের উম্মত হয়েও পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করতে পারছি না।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এ কথায় পৃথিবীবাসীর প্রায় সবাই একমত। আর তাঁর পবিত্র জন্মও হয়েছে সম্পূর্ণ অলৌকিক পন্থায়। তাঁর জন্মকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্যজনক কাজের জন্ম হয়েছে, যা সব জাতিকে বিমোহিত করেছে এবং তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বে তা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনারও। তাঁর পবিত্র জন্মের পর তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত কা’বা শরীফ দুলতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা তথা গোটা আরব জাহানের মানুষেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)’র জন্ম সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারেন (সিরাতে হালবিয়া, নবী (সা.)’র আবির্ভাব অধ্যায়)। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার স্মরণ সব জাতি সব যুগে করেছে। তিনি সেই মহামানব, যার নাম পবিত্র ইঞ্জিল ও তাওরাত শরীফে উল্লেখ আছে; সেখানে তাকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘আহমদ’ নামে আর কুরআনে পাকে ‘মুহাম্মাদ’ নামে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৪)
মহানবী (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন, সেই রাতে পারস্যের রাজ প্রাসাদে প্রবল ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়; যার ফলশ্রুতিতে তৎক্ষণাৎ সেই প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে। এই নিদর্শনের মাধ্যমে তাদের ১৪ জন বংশধর ক্ষমতাবান হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। আর এই ১৪ জনের মধ্যে পরবর্তীতে মাত্র ৪ বছরে ১০ জন শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আর বাকী শাসকরা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত উমর (রা.)’র শহীদ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। মহানবী (সা.)’র জন্মের দিন পারস্য তথা ইরানের আগুন নিভে যায়, যা হাজার বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত ছিল। ( বায়হাকি, দালাইলুন নবুয়্যাহ্ , খ- ১, পৃ. ১২৬)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহর আমার প্রতি সম্মান হলো, আমি খাত্নাবিশিষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি। যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ যেন না দেখে। (মু’জামে আওসাত, হাদীস নং ৬১৪৮)
মহানবী (সা.) এর জন্মের মাস কারো কারো মতে রমযান, কারো মতে রজব। তবে রবিউল আউয়াল মাসই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, যেহেতু নবী করীম (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন সেহেতু এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত। বিশেষত: দু’টি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথমত, সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনা মতে, এই দিনেই মহানবী (সা.) পৃথিবীবাসীকে কাঁদিয়ে ওফাত লাভ করেন। দ্বিতীয়ত, প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী এই ১২ রবিউল আউয়াল তারিখেই মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সিরাতে ইবনে হিসাম, খ- ১, পৃষ্ঠা ১৫৮)
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দিন হিসেবে সোমবার সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। কারণ জীবন চরিতকাররা সবাই একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল। এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ তারিখ এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য রয়েছে মাত্র। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল হতেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সা.)-এর ওফাতদিবস এতে সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (সূত্র: ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
মহানবী (সা.) কেবল তার অনুসারীদেরই নন, জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের আদর্শ ও পথ প্রদর্শক এবং তিনি বিশ্বমানবের মহান শিক্ষক ও অনুপম আদর্শও বটে। মানবেতিহাসের এক যুগসন্ধিকালে, অন্ধকারতম সময়ে তিনি মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। তাঁর উদাত্ত আহ্বান, নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মসাধনা, উচ্চতম নীতি আদর্শ ও অমলিন পবিত্র-মাধুর্যের মাধ্যমে তিনি অল্প দিনে এক আলোকোজ্জ্বল ও সর্বোন্নত জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন। তিনিই অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং অনাচার, পাপাচার ও বিশ্বাসহীনতার কলুষ দূরীভূত করে শান্তি, সভ্যতা, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার এক নতুন পথ রচনা করেন। বিশ্বাস, প্রজ্ঞা ও মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ নয়া সভ্যতার স্থপতি হিসেবে তিনি কেবল আরব জনগোষ্ঠীর নয়, তামাম বিশ্বের মানবম-লীর মুক্তির দিশা দান করেন। তিনি একাধারে একটি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, একটি জাতির নির্মাতা এবং একটি অতুলনীয় সভ্যতার ¯্রষ্টা। তাই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সাইয়্যেদুল র্মুসালিন ও খাতামুন্ নাবিয়্যীন।
আজকের বিশ্বসভ্যতা সবচেয়ে বেশি ঋণী ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে। এ সভ্যতার যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু মঙ্গলজনক তার পেছনে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ, শিক্ষা, নির্দেশনার অনিবার্য ভূমিকা। শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও মানবিক বিকাশের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বে মানুষ যখন ধর্মবিমুখ, বস্তুবাদী দর্শনের কবলে পড়ে যুদ্ধ-সংঘাত-সন্ত্রাস ও অশান্তির অনলে পুড়ছে, যখন ক্ষমতা, সম্পদ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে নিজের সর্বনাশকে ত¦রান্বিত করছে তখন একমাত্র ইসলাম ও বিশ্বনবী (সা.)-এর শিক্ষাই তাকে সর্বোত্তম সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হওয়ার কারণে প্রতি সোমবার সিয়াম (রোযা) পালন করা মুস্তাহাব। নবী (সা.)কে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনে আমাকে নবুওয়াত দান করা হয়েছে (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১১৬২)। পূর্বোল্লিখিত হাদীসের আলোকে উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে আমাদের করণীয় হলো এই দিনে সকল মুসলিমের রোযা পালন করা, তাঁর প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা। অন্য এক হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয়। সুতরাং রোযা অবস্থায় আমার আমলনামা উপস্থাপন করা হোক, এটা আমি পছন্দ করি।’ (তিরমিযি শরীফ, হাদীস নং-৭৪৭)। তাই মহানবী (সা.)-এর জন্মের দিনে নফল রোযা রাখা প্রকৃত নবী প্রেমের বহি:প্রকাশ। আর যে কথাটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো, মহানবী (সা.)-এর জন্মের ঘটনার চেয়েও তাঁর আদ্যোপান্ত জীবনাদর্শ আমাদের জীবন চলার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাথেয়। আর নবী করীম (সা.)-এর জন্মের বিষয়টি একান্ত তাঁর ব্যক্তিগত। কিন্তু তাঁর সিরাত বা জীবনাদর্শ সব যুগের জন্য, সব মানুষের জন্য; সর্বোপরি বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য সর্বদা অনুসরণীয়-অনুকরণীয়।
তাই বর্তমান বাস্তবতায় মহানবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করলে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিজীবনে তাঁর আদর্শের প্রয়োগ ঘটানো গেলে, পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে শান্তির সুবাতাস বইবে আর পরিলক্ষিত হবে চির শান্তিময় এক সুখী-সমৃদ্ধশালী নতুন বিশ্ব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ই-মেইল : dr.alim1978@gmail.com