ইসলামি জীবনদর্শনের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাওম। মৌলিক ইবাদাতগুলোর মধ্যে সালাত ও যাকাতের পরই সাওমের স্থান। ইসলামি বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে সালাতের পরেই সাওমের গুরুত্ব। কেননা সালাত ও সাওম ধনী-গরীব সকল শ্রেণির মানুষের উপর ফরয। আর যাকাত ও হজ্ব ফরয কেবল ধনীদের উপর।
সাওম আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো বর্জন করা, বিরত থাকা, আত্মসংযম ও কঠোর সাধনা। সাওমের র্ফাসি প্রতিশব্দ হলো রোযা যার শাব্দিক অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্বাপিত করা। সাওম মানুষের জৈবিক চাহিদা ও রিপুর অসৎ কামনা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নির্বাপিত করে। এজন্য একে সাওম বলে। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সুব্হে সাদিকের আভা ফুটে উঠার সময় থেকে সাওমের নিয়তে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি হতে বিরত থাকার নাম সিয়াম বা সাওম। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম, স্বাধীন, সুস্থ, বুদ্ধিমান নর-নারীর উপর পবিত্র রমযান মাসে রোযা পালন করা ফরযে আইন। প্রকৃত তাক্ওয়া ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সাওম এক অতুলনীয় ইবাদত। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি, আধ্যাত্¥িক উন্নতি সাধনে সাওম এক অপরিহার্য ইবাদত। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও সাম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সাওমের ভূমিকা অতুলনীয়।
মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ্ তায়ালা যে ইবাদাতসমূহ পালন করা ফরয করেছেন সাওম তার মধ্যে অন্যতম। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের সূরা আল বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের ওপর রোযা পালন ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।” এ জন্য চান্দ্রসনের রমযান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ, স্থায়ী অধিবাসী (মুকিম) এবং বিবেকবান মুসলিমের ওপর সিয়াম পালন করা ফরয। শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া সিয়াম পালন না করা ভয়ানক অন্যায়। সঙ্গত কারণ না থাকলে পরে কোনো মাসে তা কাযা করতে হবে। কেউ সাওম অস্বীকার করলে সে কাফির হিসেবে গণ্য হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স.) বলেছেন, “কেউ যদি শরয়ী কোন ওযর এবং অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও রমযানের একটি রোযা না রাখে তবে সে সারাজীবন রোযা রাখলেও তা পূরণ হবে না।”
সাওম পালন করলে ব্যক্তি এর সাওয়াব পায়। তার চেয়ে বড় কথা হলো সিয়াম সাধনা দ্বারা মানুষের পূর্বে করা বিভিন্ন ধরণের গুণাহ্ মাফ হয়। নবী করীম (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মবিচারের সাথে রমযানে সাওম পালন করে তার পূর্বকৃত সকল গুণাহ্ ক্ষমা করা হয় (সহীহ্ বুখারী)। রাসুল (স.) আরো বলেছেন, “যারা রমযানের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত একাগ্রতার সাথে রোযা পালন করেছে, তারা ঐ দিনের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদেরকে নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন (বুখারী ও মুসলিম)।
রমযান মাসকে বলা হয় রহ্মত, মাগ্ফিরাত ও নাযাতের মাস। এর প্রথম দশদিন সাওম পালনকারীদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহ্মত অবিরত ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। দ্বিতীয় দশদিন আল্লাহ্ তায়ালা ক্ষমা করেন। ব্যক্তি তার বিভিন্ন রকমের অপরাধের জন্য তাওবা করলে এ সময়ে তা কবুলের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। আর শেষ দশদিন হলো আযাব থেকে নাযাতের সময়। এ সময় আল্লাহ্ পাক জাহান্নামীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের শাস্তি মওকুফ্ করে দেন। রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেন, “তোমাদের নিকট বরকতময় রমযান মাস এসেছে- যে মাসে আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের ওপর সাওম ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশসমূহের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্রোহী-অভিশপ্ত শয়তানদের এ মাসে শৃঙ্খলিত করা হয়। রমযান মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে প্রকৃতই বঞ্চিত হয়েছে সকল কল্যাণ থেকে (সুনানে তিরমিযি)।
মানব জাতির জন্য কিয়ামত এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এ সময়ে সকল মানুষ এক জায়গায় সমবেত হবে। সূর্য সকলের অত্যন্ত নিকটবর্তী হবে অর্থাৎ মাথার খানিকটা উপরে অবস্থান করবে। প্রচন্ডতম সূর্যতাপ থেকে বাঁচার জন্য কোনো ছায়া থাকবে না। এমন অবস্থায় সাওমের কল্যাণে সাওম পালনকারীরা পাবে আরশের ছায়া। সেখানে তারা পরম শান্তিতে বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। আর বিচার কার্যের ক্ষেত্রে তারা বিশেষ সুবিধা পাবে। সাওম তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং সে সুপারিশ গৃহীত হবে। রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেন, “সাওম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সাওম বলবে, হে প্রভূ ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌনকামনা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, হে প্রভূ ! আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।” অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে (মিশকাত)।
যথাযথভাবে পালন করা সাওম কেবল আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে। এতে লোক দেখানোর ইচ্ছে প্রবল হতে পারে না। ব্যক্তি বিশেষ একান্ত নিজস্ব পরিচর্যায় তার মিথ্যাচার, গিবতের অভ্যাস রমযান মাসেই পরিত্যাগ করে। কারো সাথে পারতপক্ষে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে না। তার মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ ও ভালোবাসাই কার্যকর থাকে। ফলে সাওমের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার অগাধ সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভ করে। যেমন হাদীসে কুদ্সীতে তিনি ইরশাদ করেন, “আদম সন্তানের প্রতিটি আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ্ বলেন, শুধু সাওম ব্যতীত। নিশ্চয়ই সাওম আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেবো।
আল্লাহ্ তায়ালা পরম সত্তা। তার সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্যলাভ মানুষের জন্য এক পরম পাওয়া। তিনি সব সুন্দরের উৎস, সকল গুণাবলীর সমন্বয়। তার দীদার লাভ হলো চূড়ান্ত সাফল্য। তাক্ওয়াবান সকল মানুষেরই প্রথম প্রার্থণা হয় আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করা। সাওম এ প্রার্থণা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সাওমের মাধ্যমে সাওম পালনকারী আল্লাহর সাক্ষাৎলাভের নিশ্চয়তা পায়। রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেন, সাওম পালনকারীর জন্য দুটো আনন্দ। একটি আনন্দ তার ইফ্তারের সময়। অপর আনন্দ হচ্ছে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময় (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
মানুষের তাক্ওয়া লাভের অন্যতম পথ হলো সাওম। সাওমের মাধ্যমেই একমাত্র তাক্ওয়া অর্জিত হতে পারে। পাপাচার ও ভীতিপ্রদ বিষয় থেকে আত্মরক্ষা করার নাম তাক্ওয়া। অন্য কথায় প্রতিটি কাজ-কর্ম বৈধ হলে করা এবং অবৈধ হলে পরিত্যাগ করার নাম তাক্ওয়া। এ তাক্ওয়া গতানুগতিক ইবাদাত-বন্দেগীতে সৃষ্টি হয় না। তাক্ওয়া প্রচন্ড সাধনার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। আর সাওম হচ্ছে সে সাধনার উৎস। প্রকৃত তাক্ওয়া বা খোদাভীতি একমাত্র সাওমের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।
রমযান মাস হচ্ছে বাস্তব প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি গ্রহণের মাস। আর এই প্রশিক্ষণের দিকনির্দেশক হচ্ছে আল-কুরআন। অর্থাৎ রমযানের সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আল কুরআন অনুসারে মানুষ তাক্ওয়া অবলম্বন করবে। আর সাধারণত রমযান মাসে যাকাত বণ্টন করা হয়। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমযান মাসের দানে বহুগুণ বেশী সওয়াব বলে এ সময়ে দানের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। আর সাওমের শেষের দিকে এসে শরিয়তের নির্ধারণ অনুযায়ী ব্যক্তি তার নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে ফিত্রা আদায় করে থাকে। এভাবে সাওম সমাজের লোকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় আর্থিক উপযোগ তৈরী করে।
প্রতিবছরই রমযান মাস আসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে মানুষ তাদের বাস্তব জীবনে কুরআনের প্রতিফলন ঘটায়। ব্যক্তি ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাওমের ভিতর দিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় সাওম পালনের মাধ্যমে। আর সাওম সমাজের অবহেলিত দিনমজুর মানুষের প্রতি উদারতা ও সদ্ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। রমযান মাসে শ্রমিকদের কাজ কিছুটা হাল্কা করার জন্য রাসূল (স.) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এ মাসে যারা দাস-দাসীর প্রতি সদয় ব্যবহার করে, তথা তার কাজের বোঝা হাল্কা করে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দেন।
সাওমই একমাত্র ইবাদাত, যার সম্পর্ক সৃষ্টি জগতের কোনো মানুষের কিংবা মাখ্লুকের সঙ্গে নয়, সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে। এ জন্যে একটা লোক রোযা না রেখেও অন্য মানুষকে বুঝাতে পারে সে সাওম বা সিয়াম পালনকারী। কারণ লোকচক্ষুর অন্তরালে কিছু খেলে তো আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ দেখা সম্ভব নয়। তাই সাওমের মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানোর কোন অবকাশ নেই।
সাওম সমাজের বিত্তবান মানুষদের মনে বিত্তহীনদের জন্য প্রবল ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকভাবে সম্পদশালী মানুষের না খেয়ে থাকার দরকার হয় না। সে জন্য সে বুঝতে পারে না অনাহারে থাকার কষ্ট কেমন। সাওমের মাধ্যমে বিত্তশালী বিত্তহীন নির্বিশেষে সবাই সুব্হি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো রকম খাদ্য গ্রহণ করে না। এর ফলে সমাজের ধনী মানুষগুলো ক্ষুধার তীব্র কষ্ট সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। যার ফলে সমাজের অনাহারী সদস্যদের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে তার মধ্যে গভীর সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। রাসুলুল্লাহ্ (স.) এজন্যেই বলেছেন, “আর (রমযান মাস হলো) সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস (মিশকাত শরীফ)।
আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনের জন্য সাওমের ভূমিকা অপরিসীম। সৎস্বভাব ও নিষ্কলুষ চরিত্রের জন্য সাওমের প্রশিক্ষণ অত্যধিক কার্যকর। পানাহার ও যৌন সম্ভোগ না করা সাওমের বাহ্যিক ক্রিয়া। অন্তর্নিহীত হাকিকত হচ্ছে মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম ও ব্যবহার পরিশুদ্ধ করে তোলা, মানব সমাজে শান্তি, সুন্দর ও সত্যের প্রবাহ সৃষ্টি করা, মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ না থাকা। সাওম সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাসুলে করীম (স.) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অপকর্ম থেকে নিবৃত থাকে না, তার কেবল পানাহার ও যৌনবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত থাকায় আল্লাহর কোন দরকার নেই।” আর সাওম বা রোযা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ। যা বদ অভ্যাস ও খারাপ আচরণ থেকে মানুষকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখে। রাসূলে করীম (স.) আরো বলেছেন, যখন তোমাদের কারও নিকট রমযান মাস আসে, তখন সে যেন অশ্লীল কর্ম ও দ্বন্দ্ব-কলহ না করে। যদি তার সঙ্গে কেউ সংঘর্ষে লিপ্ত হয় কিংবা তাকে গালিগালাজ করে, তবে সে যেন বলে আমি রোযাদার।
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, পানাহার ও যৌন সম্ভোগের মতো নির্দিষ্ট কিছু বিষয় থেকে নিবৃত্ত থাকলেই সাওম সফল হয়ে ওঠে না; বরং আল্লাহ্দ্রোহী যাবতীয় বিষয় থেকে নিবৃত্ত থাকলেই কেবল সাওমের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হয়। সাওমের দ্বারা যদি পার্থিব লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা না যায়, তবে সে সাওমে উপবাস ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না। রাসূল (স.) বলেছেন, “বহু নামায আদায়কারী আছে যাদের নামায দ্বারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না, বহু সায়িম (রোযাদার) আছে, যাদের সাওমের দ্বারা তৃঞ্চা ও উপবাস ছাড়া তার কিছুই লাভ হয় না।”
লেখক: কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর। ই-মেইল : dr.alim1978@gmail.com
