প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পানি নেমে গেলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তিন মাস পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত জনগণের পুনর্বাসনে ইতোমধ্যে সরকার ১১৭ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প শুরু করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় আগামী বোরো ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত কৃষকরা নানা সুবিধা পাবেন। গতকাল শনিবার সকালে গাইবান্ধার গেবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে বন্যাদুর্গত সাধারণ জনগণের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণকালে তিনি আরো বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সরকার ৩ মাস পর্যন্ত সব ধরনের সহায়তা দেবে। এক কোটি দরিদ্র মানুষকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না।

এদিকে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে আবারো দেশবাসীকে নৌকা প্রতীকের ওপর আস্থা রাখতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ-দুর্ভোগে নৌকা ছাড়া কোনো গতি নেই। আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে তখন দেশের মানুষ ভালো থাকে। আপনারা ভালো থাকতে আবারো নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। বর্তমান সরকার সব ধরনের বিপদে পড়া মানুষের পাশে আছে এবং থাকবে। কিন্তু বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া বন্যার্তদের পাশে না দাঁড়িয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় জনগণের কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, ‘বাবা-মা, ভাই সব হারিয়ে,স্বজন হারাবার বেদনা নিয়েই আপনাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের মাঝেই আমি খুঁজে পেতে চাই আমার হারানো বাবা-মা-ভাইদের স্নেহ।’
কৃষকদের মাঝে আমন ধানের চারাও বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, বন্যায় যারা বাড়ি-ঘর হারিয়েছে, তাদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এছাড়া ভূমিহীনদের জমি দেওয়া হবে। দেশের ২১টি জেলার ফসল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,
বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনের জন্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রত্যেককে এক বিঘা জমির চারা বিতরণ করা হবে। বীজ, কীটনাশক, সারসহ অন্যান্য উপকরণও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, বন্যায় যেসব কৃষকের ফসল নষ্ট হয়েছে তাদের পর্যাপ্ত কৃষি ঋণ দেয়া হবে। ওইসব এলাকায় কোনো ধরনের ব্যাংক ঋণের সুদ আদায় করা হবে না। যারা আগে ঋণ নিয়েছিল তাদেরকেও নতুন করে ঋণ দেওয়া হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় কৃষির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনা জামানতে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বন্যার পর পর্যাপ্ত ওষুধ ও চিকিত্সা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেরামত ও নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যে সকল শিক্ষার্থীর বই-খাতা বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে তা আবার সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ায় মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে সে জন্য বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উপর জুলুম করবেন না। এখন কোনো ধরনের ঋণের কিস্তি আদায়ের চেষ্টা করবেন না।’
ত্রাণ সামগ্রী ও আমন ধানের চারা বিতরণকালে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
পরে স্থানীয় উপজেলা পরিষদ হল রুমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ ও বন্যা ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মতবিনিময় করেন। সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, সংসদ সদস্য ইউনুস আলী সরকার ও গোলাম মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম হিরু, সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, সকাল সোয়া ১০টার দিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বোয়ালিয়ায় হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এরপর তিনি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরের ঈদগাহ মাঠে বানভাসীদের খোঁজ, ত্রাণ বিতরণ ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ধানের চারা বিতরণের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কৃষকরা ধান ব্যতীত অন্য ফসল উত্পাদন করতে চান এমন স্বল্প সংখ্যক কৃষকের মাঝে বিভিন্ন জাতের বীজ, ডাল এবং অন্যান্য শস্য ও দেয়া হবে। তিনি বলেন, ধানের চারা এই আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ থেকে দেয়া শুরু হবে। একজন কৃষক ১ কেজি করে গম এবং দুই কেজি যব বীজ, এক কেজি সরিষা বীজ, ১ কেজি বাদাম বীজ এবং বিভিন্ন রকমের ডাল চাষের জন্য দেয়া হবে। দুপুর ২টায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা দুর্গত মানুষদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রী রওনা হন।
বগুড়া সংবাদদাতা জানান, সারিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজ মাঠে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী ও কৃষকদের মাঝে আমন ধানের চারা বিতরণকালে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই আমাদের বাঁচতে হবে। তাই এসব দুর্যোগে জানমালের ক্ষতি যাতে কম হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। যুব সমাজ যাতে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সর্বস্তরের মানুষকে সচেষ্ট থাকারও আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের সেবা করাটাই আমার দায়িত্ব। যখনই সুযোগ পেয়েছি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত কুমার রায়, বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনু, সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাদারা মান্নান, ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন শফিক প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রী সারিয়াকান্দির বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী ও ২৫০ কৃষককে ধানের চারা বিতরণ করেন। ত্রাণ বিতরণ শেষে সারিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজ হল রুমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুধী সমাজ ও বন্যা ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন।
