মোহাম্মদ জুবায়ের রহমান
এইতো ক’দিন আগে এক সন্ধ্যায় ‘সাপ্তাহিক দশকাহনীয়া’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, শেরপুর প্রেস ক্লাব সভাপতি, আমার অগ্রজ কলমসৈনিক এডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধারের চেম্বার টেবিলের এক কোনায় ঝকঝকে, মার্জিত, মোহনীয় কভার পেইজের একটি স্মরণিকা আমাকে আকৃষ্ট করে। স্মরণিকাটির কভারে বর্গাকার ছকে বন্দি এক জীবন্ত নাবালিকা নববধূর ছবি। ছবিটির মাথার উপরিভাগে লাল রঙের ক্রস চিহ্ন আঁকা রয়েছে। শিশু বধূর কাজল কালো চোখের করুণ আর্তি, অন্তরে অতৃপ্ত বেদনার বরিষণ যে বহমান সেটা ছবিতেই দৃশ্যমান। ছবিটি মানবিকতাহীন সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সাথে বাল্য বিয়ের অতৃপ্ত যন্ত্রণার কথাই যেন বলতে চায়। মনের গহীনে বড় হওয়ার লুকায়িত অদম্য বাসনা যে বাল্য বিয়ের ব্যধিতে আক্রান্ত তার ওই মলিন মুখটি শুধু আমাকেই নয়, সচেতন সকল বিবেকবান মানুষকে তার নিরাপত্তার মোহে আবিষ্ট করবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে শিশু নববধূর ছবিটি রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিক বিবেককে কতটুকু নাড়িয়ে তুলতে পেরেছে, তা আমার জানা নেই। তবে আমার বিবেকের দরজায় তুফান তুলতে কালক্ষেপন করেনি। তারই মানবিক বিপর্যয়ের দায় এড়াতে আজকের এই লেখা।
যে স্মরণিকা ও ছবিটির কথা দিয়ে লেখাটির শুরু করেছি তার সামান্যতম বর্ণনা না দিলে লেখাটি অপূর্ণ রয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রথম বাল্যবিয়ে মুক্ত উপজেলা ঘোষণা উপলক্ষে যে স্মরণিকা ও ছবিটির কথা বলেছি, সেটি হচ্ছে ‘জাগ্রত কালীগঞ্জ’। যা সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সৈয়দ ফারুক আহমেদের মহতী ও প্রাণান্ত উদ্যোগ আর কালীগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে। তার উদ্ভাবনী মনোভাব ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর সাহসী পদক্ষেপ, উপজেলাবাসীর পরিশ্রম ও কর্মকান্ডের মূল্য ও আগ্রহে উজ্জীবিত হোক সারাদেশ, গোটা জাতি। বড় পরিতাপ ও উদ্বেগের বিষয় যে, বিশ্বের ৫৩টি বাল্যবিয়ে প্রবণ দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
মূলকথা হচ্ছে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্য বিয়ে একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এটি একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বাল্য বিয়ের কারণে শিশুর জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে জীবনচিত্র। লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অল্পবয়স্ক মায়েরা শারীরিকভাবে অযোগ্য হয়ে থাকে, আর পুষ্টিসংক্রান্ত তথ্যও তারা সঠিকভাবে পায় না। ১৮ বছরের নিচে মা হওয়ার বেলায় অর্ধেকেরও বেশি মা মারা যায়। কিশোরী মেয়েরা মা হওয়ার বেলায় বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সন্তান জন্মের সময় একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় কিশোরীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে অনেকেই। শুধু বাল্য বিয়ে নিরোধেই কেবল মাতৃ মৃত্যুর হার কমাতে অনেকাংশেই সক্ষম। বাল্য বিয়ে, নারীর উপর সহিংসতা, অত্যাচার-নির্যাতনে দেশের বিপুল পরিমান সম্ভাবনা অকালেই হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক স্কুলপড়–য়া ছাত্রীরা অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় অন্তঃস্বত্বা হয়ে ঝড়ে পড়ছে। শিক্ষা না থাকায় কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না তারা। আর অল্প বয়সী মায়ের সন্তানের ওজন সঙ্গত কারণেই কম হচ্ছে। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এটি একটি বড় অন্তরায়। এটি জাতির জন্য একটি বিশাল সমস্যা। বাল্য বিয়ের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় দরিদ্র পরিবারগুলোতে। দরিদ্র ঘরের মেয়েরাই বাল্য বিয়ের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এর ফলে দারিদ্র দূরীকরণ ও সমতামুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়গুলো তেমন একটা আলোচিত হচ্ছে না কোথাও।
বাল্য বিয়ের পরিণতি হচ্ছে মাতৃ মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, অপুষ্ট শিশুর জন্মদান, প্রতিবন্ধি শিশুর জন্মদান, জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি, শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যাহত, শিক্ষার হার কমে যাওয়া, শিশুশ্রম বৃৃদ্ধি, তালাকের হার বৃদ্ধি, পারিবারিক অশান্তির ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, বাল্য বিয়ের ফলে বহু বিবাহ, যৌতুক ও নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্যবিয়ে একটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। বাল্য বিয়ের ফলে বিবাহিত মেয়েরা স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা বেশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। একটি শিশু শিশু অবস্থাতেই জন্ম দিচ্ছে আরেকটি অপরিপক্ক শিশুর। এভাবে আস্তে আস্তে বিকল হয়ে যেতে পারে একটি জাতি। যা সার্বিক উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। এছাড়া একজন ছেলে ২১ বছরের নিচে বিয়ে করে তখন তাকে পরিবারের দায়-দায়িত্বসহ অনেক মানসিক ও শারীরিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়। আর তখনই শুরু হয় পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ। ফলে তারা মানসম্মত শিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তির সুযোগ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা। ফলে সমাজের ও রাষ্ট্রে দেখা দিয়েছে অশান্তি। যৌতুক, দেনমোহর, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ খুন, গুমের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। এসবের সত্য-মিথ্যার ঘূর্ণিপাকে প্রতিদিন বানের স্রোতের মতো বেড়েই চলেছে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছে দেশের লাখো লাখো ভুক্তভোগি পরিবার। বছরের পর বছর ধরে আদালতে চলছে ওইসব মামলা-মোকদ্দমা। কিন্তু নিস্পত্তির কোনো বালাই নেই। ওইসব মামলার সঠিক পরিসংখ্যানও সংশ্লিষ্টদের কাছে হয়তোবা নেই। নির্যাতিত কিশোরী ও তার পরিবার নির্যাতনকারী স্বামী-সংসারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের অনেক নির্যাতিত কিশোরীবধূ মামলা পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করতে বিপথগামী হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক পরিবেশ, ঘটছে মানবিকতার বিপর্যয়। এর দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। তবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ তা এড়িয়ে যেতে পারে না।
জাতির সার্বিক উন্নয়নে নারী পুরুষের সমতা অপরিহার্য। সমাজ পরিবার থেকে বাধাগ্রস্ত হয় কন্যাশিশুর বিকাশ। বাল্য বয়সে বিয়ে দিয়ে করা হচ্ছে তাদের অধিকার হরণ। সামাজিক স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এ সমাজকে শুধু দ্রুত বদলে দিতে পারে তা নয়, দেশকে নিয়ে যেতে পারে উন্নয়ন ও মর্যাদার শিখরে। এ সত্যকে ধারণ করে আমাদের প্রেরণার পথে এগুতে হবে। এজন্য দেশ. সমাজ ও বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে আন্তরিক হয়ে একসাথে বাল্যবিয়ের মারাত্মক ব্যাধি নিরোধে নিতে হবে সময়োচিত বাস্তবমুখী নানা কর্মসূচী। চিহ্নিত করতে হবে বাল্য বিয়ের কারণসমূহ। এ অবস্থায় দারিদ্র দূরীকরণের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, কন্যা শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, দূর করতে হবে সামাজের শাস্ত্রীয় ও ধর্মীয় কুসংস্কার। কন্যা শিশুদের পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, চাকুরী নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহাররোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিপীড়নের শাস্তি সম্পর্কে সকলকে অবগত করতে হবে। অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। বহু বিবাহ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বহু বিবাহ শুধু পারিবারিক, সামাজিক জীবনে অশান্তি বাড়ায়না, দ্রুত জনসংখ্যাও বৃদ্ধি করে। বাল্যবিয়ের কাজে নিয়োজিত বিয়ে পরিচালনাকারী, সম্পাদনকারী ও নির্দেশকারী নিরোধ আইন ১৯২৯ (এ) ধারায় এক মাস কারাদন্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের কথা বলা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই নগন্য। এই আইনের পরিবর্তন করে দীর্ঘমেয়াদী সাজার ব্যবস্থাকরণ ও তা বাস্তবায়নে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও বাল্য বিয়ে নিরোধে সভা-সেমিনার, উঠান বৈঠক, সচিত্র প্রতিবেদন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, শাস্ত্রশাসিত সমাজ, তথাকথিত পুরোহিত ও কাঠমোল্লাদের জ্ঞানহীনতা, বিজ্ঞান সম্পর্কে অজানা, ধর্মশাস্ত্রকে যে যার মতো ব্যবহারের প্রবণতা, বাল্যবিয়ের অমানবিক বিধানকে সাধারণের চ্যালেঞ্জ না করার সুযোগে যোগ পরস্পরায় চলে আসছে এই অগ্রহণযোগ্য পন্থা। ওই হেমলকীয় অ্যালকোহল পান করে সমগ্র জাতি প্রতিদিন ভোগ করছে বাল্য বিয়ে নামের ক্যান্সার যাতনা। তাই আসুন, আমরা এই অবিবেচক কাজকে না বলি, ঘৃণা করি, এর প্রতিবাদে সোচ্চার হই। সর্বনাশা বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক দেশ, শিশু মৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকে মুক্তি পাক সমগ্র জাতি। বহু বিবাহ, অপুষ্টতা দূর হোক, বিচ্ছেদের মতো অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে রক্ষা পাক আমাদের নারী সমাজ, আলোয় আলোয় ভরে উঠুক আমাদের মানচিত্র। সেই কাঙ্খিত দিনের যাত্রা শুরু হোক আজ, এখন থেকেইÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম, বার্তা সম্পাদক, সাপ্তাহিক দশকাহনীয়া, শেরপুর।