শ্যামলবাংলা ডেস্ক : ত্যাগের মহিমা ও যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে গত শুক্রবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা পালিত হয়েছে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে বয়ে যায় অনাবিল আনন্দ ও খুশির বার্তা। এদিন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ঈদগাহ্, মসজিদ ছাড়াও নির্ধারিত প্রান্তরে শ্রেণী-পেশা-বয়স নির্বিশেষে ঈদের নামায আদায় করেন ও সামর্থ্যবানরা মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পশু কুরবানী করেন। এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। এদিকে, সরকার ঘোষিত ঈদের তিনদিনের ছুটি শেষ হলেও রাজধানী জুড়ে ঈদের আমেজ পরিলক্ষিত হয়েছে রবিবার। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়।
এ বছর ঈদুল আযহার সময় দেশে ছিলেন না জাতীয় দুই নেত্রীর কেউই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক গেছেন ঈদের দুই দিন আগে। তারও আগে দেশ ছাড়েন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি দীর্ঘ নয় বছর পর এবার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পরিবার পরিজন নিয়ে লন্ডনে ঈদ পালন করেন।
আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাসের ব্যত্যয় ঘটায় সারা দেশে কুরবানীর আনন্দ আয়োজন ষোলআনাই উৎসবমুখর আবহে সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিনের মুষলধারের বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার অবসান ঘটিয়ে ঈদের দিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘমুক্ত ও রোদ্রোজ্জ্বল থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্যদিয়ে ধর্মীয় এ উৎসব পালন করেছে। শঙ্কামুক্তাবস্থায় মুসুল্লিরা ঈদগাহ, মসজিদ ও খোলা মাঠে নামায আদায়ের পর পশু কুরবানী করতে পেরেছেন।
রেওয়াজ অনুযায়ী, ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল আটটায় সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সেখানে ঈদের নামায আদায় করেন। জাতীয় ঈদগাহের প্রধান জামাতে মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণ, সংসদ সদস্যগণ, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনীতিকসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ উৎসব আমেজে নামায আদায় করেন। নামায শেষে প্রেসিডেন্ট উপস্থিত সকলের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমান প্রধান ঈদ জামাতে ইমামতি করেন। নামায শেষে দেশের শান্তি ও উন্নয়ন, জনগণের কল্যাণ এবং মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়। ঈদগাহে প্রেসিডেন্টের আগমনকে স্বাগত জানান ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত ঈদের এ প্রধান জামাতে মহিলা ও বিদেশী কূটনীতিকদের নামায আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। মুসল্লিদের জন্য খাবার পানি ও মোবাইল টয়লেটেরও বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। জাতীয় ঈদগাহে সুষ্ঠুভাবে ঈদ জামাত অনুষ্ঠানে নেয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঈদগাহে সকল প্রবেশ পথ এবং ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের নামাযের স্থানসহ ঈদগাহ মাঠের প্যান্ডেলে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। প্রধান এ জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাদা পোশাকে র্যাব এবং পুলিশ সদস্যরা ঈদগাহ ময়দানে সার্বক্ষণিক তৎপর ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করে।
রাজধানীর দ্বিতীয় বৃহত্তর জামাত অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সকাল সাতটায়। বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রতি এক ঘন্টা অন্তর একটি করে মোট ৫টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেষ জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল পৌনে ১১টায়। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ঈদুল আযহার নামায আদায়ের লক্ষ্যে মুসল্লীদের সুবিধার্থে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যাপ্ত পানি ও নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উদ্যোগে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সকাল সাড়ে ৭টায় অনুষ্ঠিত ঈদ জামাতে নামায আদায় করেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্যসহ সংসদ সদস্যবৃন্দ। সেখানে সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং এলাকার সাধারণ মানুষও জামাতে ঈদের নামায আদায় করেন। নামায শেষে সেখানেও দেশ ও জাতির কল্যাণ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়।
ধর্মীয় এ উৎসবে রাজধানীর মুসুল্লীরা যাতে নির্বিঘ্নে নামায আদায় করতে পারেন, সে লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অন্যান্য বারের মতো এবারও বিভিন্ন ঈদগাহ, খেলার মাঠ ও মসজিদে ঈদ জামাত আদায়ের সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জাতীয় ঈদগাহসহ রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৯২টি ওয়ার্ডে ৩৬২টি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঈদুল আযহার ২২৮টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৩৪টি স্থানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামায আদায়ের পাশাপাশি সৌদি আরবের মিনায় পদপিষ্ট হয়ে নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে দেশের বিভিন্ন ঈদগাহে মুনাজাত করা হয়। এরপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের ভেতরের পশুত্বকে পরিহার ও আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু কুরবানী করেন তারা। পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, কারাগার ও সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
বঙ্গভবনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় : দীর্ঘদিনের রেওয়াজ অনুযায়ী এবারও বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান হয়। ঈদ উপলক্ষে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের এই শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী রাশিদা খানম ও পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট বলেন, ত্যাগের মনোভাবকে প্রসারিত করতে হবে আমাদের কর্ম ও চিন্তায়। ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যাতে কোনো অশুভ ফায়দা লুটতে না পারে সে ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ‘জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার কাজে’ লাগানোরও আহ্বান জানান তিনি।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে সপরিবারে বঙ্গভবনে আসেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন বৃটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাটসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরাও এসেছিলেন বঙ্গভবনে। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, তিন বাহিনীর প্রধানগণসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, কলামস্টি আবুল মকসুদ, শিল্পী ফকির আলমগীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সংসদ সদস্য, রাজনীতিক, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতারা বঙ্গভবনের এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যের শুরুতেই সৌদি আরবের মিনায় পদপিষ্ট হয়ে সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন তিনি। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রী আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং তাদের আপ্যায়ন করান।
