মাহফুজার রহমান মনু, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার টানে ভারতে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে জীবন বাজি রেখে সীমানা পেরিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে এসে ১১ নং সেক্টরে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন টগবগে যুবক দ্বাদশ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলাধীন চাকিরপশার ইউপি’র রতিরাম কমলওঝাঁ এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রাম চন্দ্র (৬৮)। বর্তমান তার শরীরে প্যারালাইসিসসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। স্ত্রী তিন কন্যাসহ ৫ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি। বড় কন্যার বিয়ে হয়েছে এবং বর্তমান দু’কন্যার লেখা পড়ার খরচসহ পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে তার মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার ৫ হাজার টাকা দিয়ে। জমি-জমা তেমন নেই বললেই চলে। দু’টি ঝুঁপড়ি টিনের চালার মধ্যে তার পরিবারের বসবাস। ভাংগা ভাংগা স্বরে কথা বলতে বলতে যুদ্ধের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলে বলেন, বাবুরে যুদ্ধে চোখের সামনে কত সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে অন্তরটা ফেঁটে যায়। ১১ নং সেক্টরটিতে পাক বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই চলাকালে রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত পার্শ্বে একটি গ্রামে আমরা ১০-১২ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল পাকবাহিনীর মুখোমুখি হলে পাকবাহিনী অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকে আমাদের উপর। এরই এক পর্যায়ে বুক ডাউন দিয়ে দিয়ে পাশে একটি বড় পুকুর দেখতে পাই এবং ওই পুকুরটিতে নেমে পড়ি। পুকুরের কচুরি পানা মাথায় দিয়ে ৩ দিন না খেয়ে আমরা ৫ বন্ধু আত্মরক্ষা করি। এর পর খবর আসে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যদের তুমুল প্রতিরোধ গড়লে পাক বাহিনী পিছু হটে নৌকায় উঠে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে চিলমারীতে অবস্থান নেয়। ৪দিন পর হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যদের বিশাল বহর নিয়ে আমরা চিলমারী পৌঁছুলে পাক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় এবং ওই যুদ্ধে পাক বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধারা পরাস্থ করে চিলমারী মুক্ত করে। এরপর তারা চলে উলিপুর উপজেলার পান্ডুল এলাকায়। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কুড়িগ্রাম ও রাজারহাট হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করার এক মহুর্তে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, বাবুরে এসব লিখে কি হবে, আর বা কয়দিন বাচি থাকমু বলে আর কেঁদে কেঁদে চোখের পানি মুছতে থাকে। তিনি আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, ভালভাবে চিকিৎসা করা গেলে নাতি-নাতনীর বিয়ে-সাদি দেখা সম্ভব হইত ভগবানের কৃপায়। কিন্তু অর্থ করি কোথায় পামু। যাক সব কথা শেষ কথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, ৫/৭ টার বিচারের রায়ও হয়েছে, এটা খুব খুশির খবর। এখন মরে গেলেও শান্তি পাবো। যারা ওই বর্বরতা দেখেনি, তারা কখনো বুঝবে না, তারা কি অন্যায় করেছে বাঙ্গালীদের সঙ্গে। আসলে রাজনৈতিক সকল ভেদা-ভেদ ভুলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরা দরকার। তাহলে এই সমাজে এতো বিভেদ, হানা-হানি, খুন-খারাপি ঘটতো না এবং দেশের প্রতি সকলের মায়া জন্মাতো। দেশ স্বাধীনের ৪৩ বছরেও সোনার বাংলায় পরিনত না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ জন্য এ দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের মূল্য কি এই?
