মোহাম্মদ জুবায়ের রহমান
সময় চলমান। সময়ের সাথে আমরা প্রবেশ করছি বিশ্বায়নের ডিজিটাল যুগে। বিশ্বায়নের এ যুগে নারীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা যেমন আমাদের মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব, তা রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সামাজিক পর্যায়ে নারীদের অগ্রগতিও লক্ষণীয়। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ মানবশক্তি রূপান্তরেও নারীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
এরপরও আমাদের নারীরা নির্যাতিত, নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত। ঘর থেকে শিক্ষালয়, শিক্ষালয় থেকে কর্মক্ষেত্র প্রতিটি জায়গায় প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার। রাস্তায় নামলে কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে। ইভটিজিং প্রবণতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ঘরে-বাইরে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই। গোটা সমাজ এ ভয়াবহ অবমাননাকর পরিস্থিতি সামলে উঠতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিভোর হয়ে পড়েছে। নারী উন্নয়ন, নারী শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে ইভটিজিং নামক মারাত্মক এই সামাজিক ব্যাধি। অশিক্ষা, পারিবারিক অশোভন আচরণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম দিয়েছে নৈতিক অবক্ষয়ের। সৃষ্টি করেছে অবমাননাকর অনাকাংখিত পরিস্থিতি। নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরায় নানা অপরাধ-অপকর্ম ও প্রতারণার পাশাপাশি ইভটিজিংয়ের মত ঘৃণ্য বিষয়টি সমাজে ‘প্যারাসাইট’ এর মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যা আমাদের জাতীয় জীবনে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের পথে বাধাস্বরূপ।
নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, নারীদের প্রতি কু-দৃষ্টিভঙ্গি, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার বিকাশে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। ইভটিজার শুধুমাত্র নি¤œশ্রেণীর লোকজন তা নয়, শিক্ষিত জনগোষ্ঠির মধ্যেও এর প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। ইভটিজাররা শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের মেয়েদের উত্যক্ত করছে তা-ও নয়। এর বিস্তৃতি সকল পর্যায়ে। ফলে সর্বস্তরের নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, হচ্ছে অপমানিত। ফলে অনেকেই লেখাপড়া এমনকি বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ অসহ্য অপমান সহ্য করতে না পেরে অকালে আত্মহনন করছে। এছাড়া নিজের আত্মাহুতির পাশাপাশি সন্তান-সন্ততি নিয়েও আত্মহত্যার মত অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তাদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ইভটিজিং, হতাশা, পারিবারিক নিযাতন, প্রতারণা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি নারী আত্মহনন করছে। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে উঠে এসেছে। তবে প্রাপ্ত তথ্যের চেয়েও বেশি ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার সঠিক হিসাব পাওয়া দুস্কর। এ সামাজিক ব্যাধি, প্রতিরোধ, প্রতিহত করা আমাদের মানবিক দায় নয় কি? সারা দেশে আদালতগুলোতে ইভটিজিং, যৌন হয়রানীর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়ে শতশত মামলা হয়েছে, হচ্ছে। তার চাইতেও বহুগুণ ঘটনা লোকলজ্জা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চেপে যাচ্ছে অনেক নির্যাতিতার পরিবার। আবার অনেকে মামলা করেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে। ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে অনেক প্রতিবাদকারীর মৃত্যুকে সাঙ্গ করতে হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবাদমূলক পদক্ষেপ নিতে সাহস পাচ্ছেনা নির্যাতিতার পরিবারগুলো।
অবস্থা যাই হোক, এই সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ে দল, মত নির্বিশেষে সকলকেই সোচ্চার হতে হবে। এর জন্যে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি কিছু করণীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। ক) খেলাধূলা ও শিক্ষামূলক বিনোদনের পরিবেশ তৈরি করা। খ) চাকুরী বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। গ) মাদকাসক্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্তদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা করা। ঘ) একান্নভুক্ত পরিবার তৈরিতে উৎসাহ সৃষ্টি করা। ঙ) ছেলেমেয়েদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দীক্ষা দেওয়া। চ) তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে মুক্তকরণ।
অন্যথায় তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে ছেলেমেয়েদের দ্রুত মানসিক বিকাশ ঘটায় অপ্রাপ্ত বয়সেই সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক চাহিদার। মানসিক চাহিদার অস্থিরতায় উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা সামাজিক ও মানবিকতার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপথগামী হচ্ছে। অপরদিকে মাদকের সহজলভ্যতার ফলে সেবনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সহনশীল, সংবেদনশীল, ধৈর্যশীল, পারস্পারিক বোঝাপড়া, মূল্যবোধের ঘাটতি ধীরে ধীরে বিকৃত রুচিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে হারিয়ে ফেলছে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। অপর পক্ষে নারীদের সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনচেতা মনোভাব, আকাশ সংস্কৃতি, পশ্চিমা ধাঁচের প্রভাবে অনেকেই ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে চলাফেরার দাম্ভিকতায়। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে শালীন সুলভ মনোভাব, স্ব-স্ব ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও লেবাসের পরিবর্তনও জরুরী বিষয়। নিজেদের অপূর্ণতা-অপারগতা, অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতা, ভুল-ত্রুটি, কুরুচিপূর্ণ আচরণ, পরিবর্তন ও পরিহার যেমনটা নিজের উপর বর্তায়, তেমনি সমাজ রাষ্ট্রের উপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বর্তায়।
এই ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ, স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসহ সকলকে ‘যৌন হয়রানী ও উত্যক্তকরণকে না বলুন এবং সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন, নির্যাতনমুক্ত জীবন, নির্যাতনমুক্ত কর্ম পরিবেশ চাই’ শ্লোগানে একযুগে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতামূলক র্যালি, প্রতিবাদমূলক মানববন্ধন, বিলবোর্ড, পোষ্টারিং ও মাইকিং এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে এবং নারী নির্যাতন আইনের যথাযথ পরিমার্জন ও বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দেশের প্রচলিত আইনেই সবধরনের অপরাধের দন্ডের বিধান থাকায় ইভটিজারদের বিরুদ্ধে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে যেকানে অপরাধ সেখানেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, মোবাইল ও সামাজিক গণমাধ্যমে উত্যক্তকারীদের চিহ্নিত করার জন্যে একটি হটলাইন ও আইপি এ্যাড্রেসের মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঘটনাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করে যথাযথ শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যৌন হয়রানী, ইভটিজিংয়ের মত ন্যাক্কারজনক অপরাধের প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এছাড়াও ইভটিজারদের চিহ্নিত করে বিভিন্ন সেমিনারে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের আত্ম সংশোধন ও নৈতিকতাবোধ এবং আত্মোপলব্ধি সৃষ্টিতে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতেও এ বিষয় সংক্রান্ত অধ্যায় নিযুক্ত করা যায়। নারী নির্যাতন, ইভটিজিং প্রতিরোধকল্পে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন এবং তাদের হাতে তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সামান্য হলেও বিচারিক ক্ষমতা অর্পণ করলে মফস্বলে অনেকাংশে এই প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে।
আপনার প্রিয় কন্যাসন্তানটির জন্যেই শুধু নয়, দেশের কোটি কোটি নারীর আত্মমর্যাদা রক্ষায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যে প্রতিরোধ, আজ এখনই, তাই দৃষ্টান্তমূলক প্রতিরোধ অপরাধ নির্মূলে অবশ্যই সফল হবে। আমাদের ভাবনা যদি হয় অপরাধ প্রবণতারোধ, তবে নীরবে নয়, এখনই সোচ্চার হই সেই পথে সম্মুখে এগিয়ে যাই, সেই অপরাধ নির্মূলের আলোকিত পথ ধরে। একটি ভীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম।
