আবু আব্দুল্লাহ, লোহাগড়া (নড়াইল) : একাত্তরের আট ডিসেম্বর। ভোরবেলা। প্রায় ১২ শ মুক্তিযোদ্ধা একযোগে নড়াইলের লোহাগড়া থানা আক্রমণ করেন। পুলিশ ও রাজাকারদের সঙ্গে এ যুদ্ধে শহীদ হন মোস্তফা কামাল ওরফে তাজ। সেদিন বিজয়ের পতাকা ওড়ে লোহাগড়া থানায়। এ যুদ্ধেই লোহাগড়া হানাদার মুক্ত হয়।

সেই থেকে আট ডিসেম্বরকে লোহাগড়া মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এ স্মৃতিকথা জানালেন মোস্তফা কামালের সহযোদ্ধারা। অথচ শত চেষ্টার পরও গত ৪৩ বছরেও মোস্তফা কামাল পাননি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
একাত্তরে লোহাগড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার ও বর্তমান নড়াইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এম এম গোলাম কবীর বলেন, ‘মোস্তফা কামালকে এখনও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না করা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এতে তাঁর পরিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া বিশেষ আর্থিক সুবিধাসহ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই যুদ্ধে মোস্তফা কামাল এবং কোলাদিঘলিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমান শহীদ হন।’
কথা হয় মোস্তফা কামালের যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার বীরপ্রতীক গোলাম আজাদ দারার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওইদিন ভোরে শুরু হয় যুদ্ধ। তাজ ছিলেন আমার বাঁ পাশে। অদম্য সাহসীকতায় গুলি ছুঁড়ছিলেন। সকাল আটটা হবে তখন। হঠাৎ জয় বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে ওঠেন। তখন একটি গুলি তাঁর বাঁ কানের পাশে বিদ্ধ হয়ে ডান চোয়াল দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তাজ। তখনই শহীদ হন। সহযোদ্ধারা হয়ে যায় অগ্নিমূর্তি। এরপর প্রচন্ড আক্রমণে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা থানা দখলে নেই। ওই দিনই আমরা সামরিক কায়দায় সম্মান দেখিয়ে লোহাগড়া উপজেলার ইতনা স্কুল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের পাশে তাঁকে দাফন করি।’
মোস্তফা কামালের বাড়ি যশোর সদর উপজেলার জঙ্গলবাধাল গ্রামে। বাবা আব্দুল গফুর এবং মা আমেনা বেগমের ছয় ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। ভাই-বোনের মধ্যে মোস্তফা মেজ। ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘শত চেষ্টায় ৪২ বছর পর গত বছর ২৬ নভেম্বর মোস্তফা কামালকে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ দেওয়া হয়েছে (নম্বর-১৯৪৪৭১)। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পেতে আবারও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’
মা আমেনা বেগম (৮৫) জানান, একাত্তরের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তাজ। বয়স প্রায় ১৬। এপ্রিল মাসে আমাদের না জানিয়েই ভারতে চলে যায় প্রশিক্ষণ নিতে। প্রায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে সে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়। আমেনা বেগম আবেগমাখা কন্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলার স্বাধীন পতাকার মধ্যে আমার তাজকে দেখতে পাই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়ের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে কবরে যেতে চাই।’
শহীদ মোস্তফা কামাল স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ইতনা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ‘স্কুলের মধ্যে শহীদ তাজের কবর থাকায় ছেলেমেয়েরা আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।’
