ইমরান হোসাইন, পুঠিয়া থেকে ফিরে : দিনের প্রতিটি মুহূর্ত পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠছে চারিদিক। বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলে অতিথি পাখিদের অভায়াশ্রম ও পাখির মেলা বলতে গেলে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভালুকগাছী গ্রাম। বিগত সাত বছর থেকে অতিথি পাখিরা ভালুকগাছী গ্রামের প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক আবদুল হামিদের আম বাগানে বসত গেড়েছে।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ পাখি দেখতে ও তাদের রকমারী কলতান শুনতে আসছেন স্কুল শিক্ষক আবদুল হামিদের আম বাগানে। প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। বিশেষ করে বর্তমানে ঈদ আনন্দকে আনন্দময় করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন পাখিদের গ্রাম ভালুকগাছী হামিদ মাস্টারের আম বাগানে। পুরো বাগান জুড়ে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বাহারী রঙের হরেক রকমারী অতিথি পাখির মেলা। সব থেকে মজার বিষয় হলো আবদুল হামিদের বাগান ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির গাছে একটিও পাখি বসে না।
শিক্ষক আবদুল হামিদের পুত্র রাজশাহী সরকারি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র রিপন জানান, এক একর আয়তনের তাদের আম বাগানে বিগত সাত বছর ধরে বৈশাখ পড়লেই অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুন নতুন পাখি এসেছে। পাখি আসলে আমাদের গাছে ছাড়া অন্য মানুুষের গাছে বসে না। বিগত দিনের চেয়ে এবার অনেক বেশী পাখি আসায় বাগানের গাছে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পাখিরা আমাদের আঙিনার আমগাছ, নিম গাছ, বেল গাছসহ সব গাছে বসেছে তারপরেও তারা অন্য কোনো মানুষের গাছে বসে নি। শুধু আমাদের গাছেই পাখি বসে কেন? এ বিষয়টি এলাকাবাসীর মাঝে আলোচনা সমালোচনা হয়। অতিথি পাখিদের সংরক্ষণ ও পাখি নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পাখি সংরক্ষণ কমিটির সদস্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকবীর হাসান বলেন, এই পাখিরা আমাদের অতিথি। পাখিদের নিরাপদ বসবাসের সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পাখি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা কমিটির সব সদস্যরা দিনে ও রাতে পর্যায়ক্রমে পাখিদের অভয়াশ্রমের চারপাশে পাহারা দিয়ে থাকে যাতে কেউ পাখি শিকার না করতে পারে। বর্তমানে নজর কাড়া পাখিদের অভায়াশ্রম হিসেবে গড়ে উঠেছে আবদুল হামিদ মাস্টারের আম বাগান। ঈদ আনন্দকে আনন্দময় করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন পাখিদের গ্রাম ভালুকগাছী হামিদ মাস্টারের আম বাগানে।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে পাখিদের অভায়াশ্রম পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় অনেক পাখি প্রেমি মানুষদের সঙ্গে। পাখি দেখতে আসা রংপুরের শুটিমারী এলাকার আলম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলম বলেন, আমার নড়াইলের এক বন্ধু ১৫দিন আগে এখানে এসে পাখিদের মেলা দেখে গিয়ে আমার ফোন করে বলে বাহারী রঙের রকমারী লাখো অতিথি পাখিদের মেলা বসেছে রাজশাহীর পুঠিয়ার ভালুকগাছী গ্রামে। বিষয়টি আমার পরিবারকে বললে তারা সবাই পাখি দেখার জন্য উৎসাহ দেখায়। তাই স্বপরিবারে এবারের ঈদের আনন্দ পাখিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে ছুটে এসেছি ভালুকগাছীতে। নানান প্রজাতির পাখিদের কলতান শুনে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা আজিমপুর থেকে পাখি দেখতে আসা প্রকৌশলী এসএম হেয়ায়েত করিম বলেন, দেশে এতো সুন্দর পাখি রয়েছে কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। এই পাখিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী।
গত বছর বিষয়টি আবদুল হামিদ মাস্টার রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষকে জানালে বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোল্লা রেজাউল করিম এলাকা পরিদর্শন করে আবদুল হামিদ মাস্টারের পুরো এলাকাকে পাখিদের অভায়াশ্রম সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে মাইকিং, লিপলেট বিতরণসহ সংরক্ষিত এলাকার চারিদেকে সাইন বোর্ড স্থাপন করেছেন।
বিষয়টি বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা প্রধান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সামজিক বন অধিদফতরকে জানালে গত ২৬ জুন সামাজিক বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক কর্মকর্তা ইউনুস আলী, সামাজিক বন অধিদফতর বগুড়া জোনের বন সংরক্ষক ড. লস্কর মাকসুদুর রহমান, রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোল্লা রেজাউল করিম ও জেলা সামাজিক বন অধিদফতরের বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র পাখিদের সংরক্ষিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
পাখিদের বসবাসের আশ্রয়দাতা স্কুল মাস্টার আবদুল হামিদ বলেন, বিগত সাত বছর থেকে পাখিরা আমারা পুরো এলাকাজুড়ে বসবাস করছে। পাখি আসাতে আমি খুবই আনন্দিত। পাখি আমার বাগানে বসবাস করাতে আমার বছরে প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আম গাছে পাখি বসার কারণে আম মৌসুমে গাছে কীটনাশক ¯েপ্র করতে না পারায় গাছে আর আম ধরে না। পাখিদের ভারে গাছের অকে ডাল ভেঙে যাচ্ছে। পাখি আসায় বিগদ সাত বছরে আমার ন্যূনতম ২৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। অনেক লোকজন বলেছে পাখিদের তাড়িয়ে দিতে কিন্তু পাখিদের ভালোবেসে আমি তা করতে পারি নি। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণসহ পাখি আশ্রয় সংশ্লিষ্ট দফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে আমার আকুল আবেদন আমার পাখি আশ্রয় এলাকা পরিদর্শন করে সরকারিভাবে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে এলাকাটিকে ঘোষণা করে তা সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
